খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা

খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা – আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর মুনাজারার পরে খারেজিদের মধ্য হতে প্রায় ২ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো খারেজি তাদের দলত্যাগ করে আলী রা. এর নিকট চলে আসে।

এরপর হযরত আলী রা. নিজেই খারেজিদের কাছে যান এবং তাদের সাথে কথা বলেন। ফলে তারা কুফা শহরে ফিরে আসে।

কিন্তু গোঁড়ামির কারণে তারা বেশি সময় সেখানে থাকতে পারে নি। কারণ, তারা ভেবে নিয়েছিল, আলী রা. সালিশের ঘটনা থেকে রুজু বা ফিরে এসেছেন।

পড়ুন: খারেজি কারা?

এই কথা তারা লোকদের মাঝে প্রচার করছিল। এই প্রেক্ষিতে আশআস ইবনু কায়েস নামক একজন ব্যক্তি খলিফা আলী রা. এর নিকট এসে বললেন,

মানুষ বলাবলি করছে, তাদের কারণে আপনি কুফরি থেকে ফিরে এসেছেন। এটা কি সত্যি?

আলী রা. এর ভাষণ – খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা

হযরত আলী রা. আশআস ইবনে কায়েসের কথা শুনে জুমার দিন খুতবা দিলেন। হামদ ও সালামের পর তিনি খারেজি মতাদর্শী লোকদের সঙ্গে তার মতানৈক্যের স্বরূপ উন্মোচন করেন।

“মারবিয়াতু আবু মিখনাফ ফি তারিখুত তাবারী” কিতাবের ৪৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, আলী রা. এর খুতবা দেয়ার সময় একলোক দাঁড়িয়ে বললো,

لا حكم إلا الله  অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম চলবে না। এরপর মসজিদের বিভিন্ন কোণ থেকে তারা এরূপ স্লোগান দিতে থাকে।

আমিরুল মুমিনীন আলী রা. তাদেরকে বসতে বলেন। এরপর তিনি বলেন, তোমাদের এই কথা ঠিক আছে। কিন্তু তোমাদের কথার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমি তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।

আলী রা. মিম্বার থেকে তাদেরকে বসে যেতে বলেন। এ সময় এক ব্যক্তি তার দুই কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কুরআনের এই আয়াত পড়তে লাগলো,

وَ لَقَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ لَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শিরক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

সূরা যুমার। আয়াত ৬৫

আমিরুল মুমিনীন আলী রা. তাদের এই কথার জবাবে বললেন,

فَاصۡبِرۡ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰهِ حَقٌّ وَّ لَا یَسۡتَخِفَّنَّکَ الَّذِیۡنَ لَا یُوۡقِنُوۡنَ

তুমি ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি চিরসত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, তারা যেন তোমাকে বিচলিত করতে না পারে।

সূরা রুম। আয়াত ৬০

উপরোক্ত ঘটনা আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড ৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৫০৩-৫১০ পৃষ্ঠা এবং মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ৫। মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৮৭-৯২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।

আলী রা. এর সিদ্ধান্ত – খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা

হযরত আলী রা. খারেজিদের এই চরমপন্থি দলটি সম্পর্কে ন্যায়নিষ্ঠ নীতি গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, যতক্ষণ তোমরা আমাদের সাথে থাকবে, ততক্ষণ তোমরা তিনটি অধিকার পাবে।

১. তোমাদেরকে মসজিদে সালাত আদায়ে কোনো বাধা দেয়া হবে না।

২. আমাদের সাথে একত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে প্রাপ্য অনুযায়ী তোমরা গনীমত লাভ করবে।

৩. আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, আমরাও তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো না।

এরপর আলী রা. একজন ঘোষণাকারীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন, যারা হাফেজ তারা যেন আমিরল মুমিনীনের নিকট আসে।

হাফেজরা একত্রিত হলে আলী রা. পবিত্র কুরআনের একটি কপি এনে সবার সামনে রাখলেন। এরপর তিনি হাতের আঙ্গুল দিয়ে কুরআনে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন,

হে কুরআন! তুমি লোকদের নিকট তোমার কথা জানাও।

উপস্থিত লোকেরা আলী রা. কে বললো, আমিরুল মুমিনীন! কুরআনের কপি তো কাগজ আর কালি ছাড়া কিছু নয়। সেটা কিভাবে কথা বলবে?

জবাবে আলী রা. বললেন, তোমাদের ওই সকল সাথী, যারা আমার থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান নিয়েছে,

তাদের ও আমার মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব রয়েছে।

মহান আল্লাহ তার কিতাবে একজন পুরুষ ও একজন নারীর ক্ষেত্রে বলেছেন,

وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِهِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَهۡلِهٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَهۡلِهَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰهُ بَیۡنَهُمَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا

যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সম্যক অবগত।

সূরা নিসা। আয়াত ৩৫

সেই মোতাবেক মুসলমানদের রক্ত তো আরো গুরুত্বপূর্ণ একজন নারী ও পুরুষের থেকে।

তারা আমার ব্যাপারে আরো অভিযোগ এনেছে > আলী রা. এর ব্যাপারে খারেজিদের অভিযোগগুলো পড়ুন

পূনরায় খারেজিদের দলত্যাগ

পরিবেশ ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে খারেজিরা আলী রা. এর সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে আমির মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নিল।

এই লক্ষ্যে সকল খারেজি সমবেত হলো আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্হাব রাসিবির ঘরে। ইবনে ওয়াহহার তাদের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়।

দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে, আখিরাতের প্রতি আস্থাবান হতে, ভালো কাজ করতে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে সে তাদেরকে উৎসাহিত করে।

এরপর সে খারেজিদের বলে, সালিশ ব্যবস্থা হলো সুষ্পষ্ট যুলুম। আমরা এই সালিশ মানি না।

যে জনপদের অধিবাসীরা জালিম, সেখানে আমাদের থাকা উচিৎ নয়।

এভাবে এক এক করে হারকুস ইবনে যুহাইর, হামজা ইবনে সিনান ভাষণ দেয়। এরপর তারা তাদের নেতা নির্ধারণ করতে বসে।

প্রথমে জায়েদ ইবনে হিসন আত তায়ির নিকট আমিরের পদ গ্রহণ করতে প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।

পড়ুন: আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা কে ছিল? সে কিভাবে ফেতনা ছড়িয়েছে?

এরপর হারকুস ইবনু যুহাইর, হামজা ইবনে সিনান ও শুরাইহ ইবনে আবু আওফা এর নিকট আমির হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।

কিন্তু তারাও অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহ্হাব রাসিবির কাছে প্রস্তাব দিলে সে তা গ্রহণ করে।

তখন খারেজিরা চিন্তা-ভাবনা করে যে, তারা মাদায়েন এলাকা দখল করবে। তখন জায়েদ ইবনু হিসন তায়ি তাদেরকে বললো,

তোমরা মাদায়েন দখল করতে পারবে না। সেখানে দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী আছে। তাদেরকে তোমরা কিছুতেই পরাস্ত করতে পারবে না।

তারা তোমাদের তাড়িয়ে দিবে। আমার পরামর্শ হলো, তোমরা তোমাদের সকল সাথি-বন্ধুদের জাওখি নদীর সেতুর কাছে সমবেত হতে বলো।

জায়েদ আরো বললো, কুফা থেকে তোমরা দলবন্ধভাবে বের হয়ো না। বরং একজন একজন করে বের হও।

যাতে কেউ তোমাদের বিষয়টি বুঝতে না পারে।

খারেজিদের কুফায় ফিরে আসা

খারেজিদের জাওখি নদীর নিকট সমাবেত

জায়েদ ইবনে হিসন তায়ির প্রস্তাব সকলে পছন্দ করে। তাই তারা বসরা ও অন্যান্য স্থানে বসবাসকারী তাদের অনুসারীদের নিকট পত্রসহ লোক পাঠালো।

যেন তারা দ্রুত নদীটির নিকট উপস্থিত হয়। শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হতে এই সিদ্ধান্ত নেয় খারেজিরা।

তারা নিজেদের পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের থেকে পৃথক হয়ে রওয়ানা হয়।

তারা ভাবতে থাকে, এর দ্বারাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাদের প্রতি খুশী হবেন।

এভাবে তারা নাহরাওয়ান নামক স্থানে একত্রিত হয়। এখানে এসে তারা বিরাট শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।

হযরত আলী রা. এই সংবাদ পেয়ে তাদের নিকট চিঠি প্রেরণ করলেন। তিনি লিখলেন, তোমরা পূর্বের অবস্থানে ফিরে এসো।

শিয়া মতবাদ কি? ও তাদের কি কি আকিদাগত বিচ্যুতি আছে, পড়ুন

আর আমাদের সাথে সিরিয়াবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। কিন্তু খারেজিরা এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে,

যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আপনার কুফরির কথা স্বীকার না করবেন এবং তওবা না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ফিরে আসবো না।

আলী রা. তা অস্বীকৃতি জানালেন। তাদের ব্যাপারে আমিরুল মুমিনীন আলী রা. নিরাশ হয়ে পড়লেন।

তথ্যসুত্র

খারেজি। ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবী। পৃষ্ঠা ৩১-৩৮

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস

গাজ্জার জন্য অনুদান

৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জায় অসংখ্য মানুষ আহত ও শহীদ হয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী হারিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে গাজ্জার ৯৮% মানুষ অনাহারে জীবন-যাপন করছে। গাজ্জার মানুষের এই দুঃসময়ে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কে দাঁড়াবে?

আর-রিহলাহ ফাউন্ডেশন তুফানুল আকসা যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করে আসছে। এই মহান কাজে আপনিও আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন।

অনুদান দিন

Scroll to Top