খলিফা উসমান ও আবু যর গিফারী এর মাঝে সম্পর্ক

আমিরুল মুমিনীন খলিফা খলিফা উসমান ও আবু যর রা. মধ্যে একটি ঘটনা নিয়ে সমালোচনা হলো, উসমান রা. আবু যর গিফারী রা. কে রাবজা এলাকায় নির্বাসিত করেছিলেন।

এ ছাড়াও অনেক ইতিহাসবিদরা ধারণা করে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা শামে গিফারী রা. এর সাঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এটি নিছক ভ্রান্ত চিন্তা।

নবীজির হারানো আংটি ও মুসলমানদের দুশ্চিন্তা

৩০ হিজরীতে রাসুল সা. এর পবিত্র আংটিটা একটি কূপে হারিয়ে গিয়েছিল।

উক্ত আংটিটা নবীজির পর আবু বকর রা. এবং তার পর উমর রা. ও এরপর উসমান রা. এর নিকট এসেছিল।

সেই আংটিটা মদীনা থেকে দুই মাইল দূরে মসজিদে কুবার কূপ “বীরে আরিস” এ পড়ে হারিয়ে যায়।

এই বরকতপূর্ণ আংটি হারিয়ে যাওয়ায় মুসলমানরা চিন্তিত ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন।

ইত্যবসরে শামে হযরত আবু জর গিফারী রা. তার দুনিয়াবিমুখতার কারণে মানুষকে জোরালোভাবে আদেশ দিচ্ছিলেন যে, যেন তারা তাদের সব সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে।

এর ফলে সমাজে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হলো। শামের গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া রা. এই ঘটনা হযরত উসমান রা. কে অবহিত করেন।

ফলে উসমান রা. আবু যর গিফারী রা. কে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি যেন মদীনায় চলে আসেন।

আর মুয়াবিয়া রা. কে চিঠি লিখলেন যে, তুমি আবু জর রা. কে স্ব-সম্মানে রাহবার ও পাথেয় দিয়ে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও।

আবু যর রা. এর বসবাস

হযরত উসমান রা. চাচ্ছিলেন, যেন আবু জর মদীনাতেই বসবাস করেন। কিন্তু তিনি মদীনা থেকে দূরে রাবজা নামক স্থানে একটি খেজুর বাগানের নিকট অবস্থান নিলেন।

উসমান রা. তখন তাকে একপাল উট ও দুজন গোলাম হাদিয়া দিলেন। যেন তিনি শান্তিতে বসবাস করতে পারেন।

সুতরাং বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, হযরত আবু জর রা. সম্পর্কে উসমান রা. কে যেই অপবাদ দেয়া হয়, তা সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, হযরত আবু যর রা. স্বেচ্ছায় রাবজা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।

এর কারণ ছিল তার কুরআনের আয়াতের উপর কিয়াস।

তাছাড়া হযরত আবু যর রা. রাসূল সা. এর যুগেও রাবজাতে বসবাস করতেন।

সুতরাং এই কথা বলা যায় না যে, তাকে সেখানে নির্বাসন করা হয়েছিল।

জায়েদ ইবনে ওয়াহাব এর বর্ণনা

আমিরুল হাদীস ইমাম বুখারী রহ. সহীহ সনদে জায়েদ ইবনে ওয়াহাব রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন যে,

রাবযা এলাকা দিয়ে অতিক্রমকালে আমার সাথে আবু যর রা. এর সাক্ষাৎ হয়।

তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি এখানে কেন বসবাস করছেন?

তখন তিনি জবাবে বলেন, শামে অবস্থানকালে আমার সাথে সূরা তওবার ৩৪ নং আয়াতের নিয়ে মুয়াবিয়া রা. এর মধ্যে মতবিরোধ হয়। যেখানে বলা হয়েছে,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَ الرُّهۡبَانِ لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ یَکۡنِزُوۡنَ الذَّهَبَ وَ الۡفِضَّۃَ وَ لَا یُنۡفِقُوۡنَهَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۙ فَبَشِّرۡهُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ

হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদের অনেকেই (ইয়াহুদ ও খৃষ্টানদের আলেম ও ধর্ম যাজক) মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে। আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয়। যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।

সূরা তওবা, আয়াত ৩৪

মুয়াবিয়া রা. এর বক্তব্য ছিল যে, এই আয়াত আহলে কিতাবদের ব্যাপারে অবতীর্ণ।

কিন্তু আমি (আবু যর গিফারী রা.) বলি, এই আয়াত আমাদের ও তাদের সকলের সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছে।

এক সময় মু‘আবিয়া (রাঃ) ‘উসমান (রাঃ)-এর নিকট আমার নামে অভিযোগ করে পত্র পাঠালেন। তিনি পত্রযোগে আমাকে মদীনায় ডেকে পাঠান।

মদীনায় পৌঁছলে আমাকে দেখতে লোকেরা এত ভিড় করলো যে, এর পূর্বে যেন তারা কখনো আমাকে দেখেনি।

‘উসমান (রাঃ)-এর নিকট ঘটনা বিবৃত করলে তিনি আমাকে বললেন,

ইচ্ছা করলে আপনি মদীনার বাইরে নিকটে কোথাও থাকতে পারেন। এ হল আমার এ স্থানে অবস্থানের কারণ।

খলীফা যদি কোন হাবশী লোককেও আমার উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেন তবুও আমি তাঁর কথা শুনব এবং আনুগত্য করবো।

অপপ্রচার সম্পর্কে আবু যর রা. এর বক্তব্য

উপরোক্ত হাদীস দ্বারা এটা জানা যায় যে, হযরত আবু যর রা. এর সাথে মুয়াবিয়া রা. এর ফিকহী বিষয়ে মতানৈক্য হওয়ায় এরপর উসমান রা. তাকে মদীনায় ডেকে পাঠান।

এরপর উসমান রা. তাকে মদীনায় থাকতে বলেন। কিন্তু আবু যর রা. স্বেচ্ছায় মদীনার বাহিরে রাবজা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন।

হযরত উবাদা উবনে সামিত রা. বলেন, আমি আবু যর রা. এর সাথে উসমান রা. এর নিকট যাই।

তখন আবু যর রা. তার মাথা উন্মুক্ত করে বলেন,

আমি খারেজি বা ফেতনাবাজদের অন্তর্ভুক্ত নই। উসমান রা. তখন বললেন,

আমি আপনাকে এ জন্য ডেকে পাঠিয়েছি যে, আপনি মদীনায় বসবাস করবেন।

তখন আবু জর রা. বললেন, এর কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে রাবজায় থাকার অনুমতি দেন।

তখন খলিফা উসমান আবু যর রা. কে বললেন, আচ্ছা। সেখানে থাকুন।

সিয়ারু আলামিন নুবালা গ্রন্থের একটি সহীহ সনদে জানা যায়, আবু যর রা. এর মা বলেন, আল্লাহর শপথ! উসমান রা. আবু জারকে রাবজায় নির্বাসিত করেন নি।

রাসূল সা. আবু জারকে বলেছিলেন, যখন মদীনার জনপদ সিলা পাহাড় পর্যন্ত চলে যাবে, তখন তুমি শাম এলাকায় চলে যাবে।

আহনাফ ইবনে কায়েস রহ. এর বর্ণনা

বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস রহ. বলেন, একবার আমি কুরাইশদের একদল লোকের সাথে বসা ছিলাম।

তখন সেখানে রুক্ষ চুল, মোটা কাপড় ও খসখসে শরীরবিশিষ্ট এক ব্যক্তি এসে তাদের পাশে দাঁড়ালো।

এরপর তাদের সালাম দিয়ে বলতে শুরু করলো,

যারা সম্পদ জমা করে রাখে, তাদেরকে এমন গরম পাথরের সংবাদ দাও, যা জাহান্নামের আগুন দ্বারা উত্তপ্ত করা হবে। তা তাদের বুকের উপর স্থাপন করা হবে। ফলে পাথরটি কাঁধের হাড়ের মধ্যখান ভেদ করে বেরিয়ে যাবে। এরপর সেটি তাদের কাঁধের হাড়ের উপর রাখা হবে এবং তা তাদের বুক ভেদ করে চলে যাবে।

পরে লোকটি ফিরে গিয়ে একটি স্তম্ভের পাশে বসে পড়ে। আমি তার নিকট গিয়ে বসি। আমি তখন তাকে চিনতাম না।

আমি তাকে বলি, মনে হচ্ছে লোকজন আপনার বক্তব্য পছন্দ করে নি। তখন তিনি বললেন, তারা তো কিছুই বুঝে না।

আনুষাঙ্গিক বর্ণনা ও কিছু দ্বন্দ্ব নিরসন

অনেকেই ভেবে থাকে যে, বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যর রা. ফেতনাবাজ আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।

তারা ভাবে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা হযরত আবু যর রা. কে মানুষের সম্পদ অর্জন নিয়ে কথা বললে এবং তাদেরকে সতর্ক করতে বললে তিনি তা করেন।

কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অগ্রহণযোগ্য কথা। আর অনেকে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয় যে, তিনি ভুল ফাতওয়া প্রচার করতেন।

বস্তুত হযরত আবু যর রা. এর দুনিয়াবিমুখতা এবং অল্পতুষ্টির প্রতি অধিক তাগিদ আরোপ করা শরিয়তেরই বিভিন্ন দলিলকে সামনে রেখে মূল্যায়ন করা হয়েছিল।

কোনো সাহাবী হযরত আবু যর রা. কে বলেন নি যে, আপনি ভুলের উপর আছেন।

কেননা তারা জানতেন যে, যে দুনিয়াবিমুখ হওয়ার শক্তি রাখে, সেটা তার জন্য প্রশংশনীয়।

খলিফা হযরত খলিফা উসমান আবু যর রা. কে বলেছিলেন, যে বৈধ হিসেবে গণ্য, তা থেকে মানুষকে বাধা দিবেন না।

ইমাম বুখারী রহ. এর মতে, আবু যর রা. বলেছেন, তুমি যদি আমার মাথায় তরবারি রাখ, তাহলে মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে আমি রাসূলের আদেশ বলে যাব।

সর্বশেষ কথা হলো, হযরত আবু যর রা. এর নিকট হয়তো নবীজির সম্পদের ব্যাপারে নম্রতাপূর্ণ হাদীসগুলো পৌঁছে নি।

তাই তিনি যেটা শুনেছিলেন, সেটার উপরই আমল করে গেছেন। আল্লাহ অধিক অবগত।

তথ্যসুত্র

উসমান ইবনু আফফান, পৃষ্ঠা ৪১৮-৪৩০

মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৬৪-১৬৬

গাজ্জার জন্য অনুদান

৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জায় অসংখ্য মানুষ আহত ও শহীদ হয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী হারিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে গাজ্জার ৯৮% মানুষ অনাহারে জীবন-যাপন করছে। গাজ্জার মানুষের এই দুঃসময়ে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কে দাঁড়াবে?

আর-রিহলাহ ফাউন্ডেশন তুফানুল আকসা যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করে আসছে। এই মহান কাজে আপনিও আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন।

অনুদান দিন

Scroll to Top