আবু বকর রা. জন্ম ও বংশ পরিচয়
খলিফা হযরত আবু বকর রা. ছিলেন নবী সা. এর অন্যতম সঙ্গী ও মুসলমানদের প্রথম খলিফা। তিনি রাসূল সা. এর দুই বছর পরে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
আর এই জন্মের ঘটনাকে তৎকালীন আরবের বিখ্যাত আরেকটি ঘটনা দ্বারা বর্ণনা করা যায়।
তা হলো, খৃষ্টান বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক হাতীর পাল নিয়ে কা’বা ঘর ধ্বংস করার অভিযানের ১ বছর ৮ মাস পরেই আবু বকর রা. জন্মগ্রহণ করেন।
আর নবীজির জন্ম হয়েছিল হাতীর ঘটনার ৫৫ দিন পরে। তাই রাসূল সা. এর থেকে বয়সে দুই বছরের ছোট ছিলেন আবু বকর।
গোত্র
আবরে যতগুলো গোত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তার মধ্যে মক্কায় সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গোত্র হলো, কুরাইশ গোত্র।
কিন্তু এই কুরাইশ গোত্রেরও আরো বেশ কিছু শাখা গোত্র রয়েছে। সেসব শাখা গোত্রগুলোর অন্যতম একটি হলো বনু তাইম গোত্র।
এই বনু তাইম গোত্রেই জন্মগ্রহণ করেন হযরত আবু বকর রা.। তার বংশ ক্রমানুসারে দেয়া হলো,
আবু বকর এর বাবার নাম আবু কুহাফা, তার বাবার নাম আমর, তার বাবার নাম কা’ব, তার বাবার নাম সাঈদ, তার বাবার নাম তাইম, তার বাবার নাম মুররা, তার বাবার নাম কা’ব ।
মুররা বিন কা’ব এর সাথে গিয়ে আবু কুহাফার বংশ কুরাইশের বিখ্যাত হাশেম গোত্রের সাথে মিলে যায়।
নাম
শৈশবে আবু বকর এর নাম রাখা হয়েছিল আব্দুল কা’বা। যার বাংলা অর্থ হলো কা’বার গোলাম।
ইসলাম গ্রহণ করার পর হুজুর সা. তার নাম পরিবর্তন করে আব্দুল্লাহ রাখেন।
পরবর্তীতে তাকে সিদ্দীক ও আতীক শব্দ উপাধী হিসেবে দেয়া হয়।
আবু কুহাফা রা. – হযরত আবু কুহাফা রা. ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আবু বকর রা. এর পিতা। তিনি ছিলেন দীর্ঘ হায়াত প্রাপ্ত একজন ব্যক্তি। আল্লাহ তাকে চার প্রজম্ম পর্যন্ত দেখার সুযোগ দিয়েছেন।
আবু বকর রা. এর পিতা আবু কুহাফা রা.
হযরত আবু কুহাফা রা. এর মূল নাম ছিল উসমান ইবনে আমের আল তাইমী আল কুরাইশী। তিনি ছিলেন বিখ্যাত কুরাইশ বংশের “তাইম” শাখার গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি।
আবু কুহাফার জন্ম
উসমান ইবনে আমের আল কুহাফা জন্মগ্রহন করেন ১ জুলাই ৫৪২ খৃষ্টাব্দে। তার জন্মস্থান হলো, আরবের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শহর মক্কায়।
আবু কুহাফার শৈশবকাল
আবু কুহাফা মক্কা শহরেই শৈশব থেকে বসবাস করতেন। তিনি শৈশবকালে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ করেছেন।
যা তাকে পরবর্তীতে মক্কার উল্লেখযোগ্য একজন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
আবু কুহাফার সন্তানগণ
আমের আবু কুহাফার ঘরে প্রথমে কয়েকজন সন্তান জন্মগ্রহন করে। কিন্তু শৈশবেই তারা ইন্তিকাল করে।
আবু বকর রা. এর জন্ম হওয়ার পর যখন দেখা গেল, তিনি জীবিত তখন তার নাম দেয়া হয় আতিক (মুক্তিপ্রাপ্ত) নামে।
পরবর্তীতে আরো দুইজন পুত্র সন্তান আবু কুহাফার ঘরে জন্মগ্রহন করে।
আবু বকর রা. এর ইসলাম গ্রহন ও আবু কুহাফার প্রতিক্রিয়া
রাসূল সা. যখন ইসলাম প্রচার শুরু করলেন তখন আবু বকর রা. ছিলেন তার বিশ্বস্ত বন্ধু। আবু বকর রা. নবুয়তের দ্বিতীয় দিনই ইসলাম গ্রহন করেন।
আবু কুহাফা তখনও ইসলাম গ্রহন করেন নি। কিন্তু তিনি পুত্রের এমন পরিবর্তনে কোনো বাধা দিলেন না।
“কিন্তু তিনি আলী রা. দেখিয়ে বলতেন, এই ছেলেপেলেরা আমার ছেলেটাকেও বিভ্রান্ত করে ফেলেছে।”২
আবু বকর রা. এর হিজরতের দিনকার ঘটনা
যখন আবু বকর রা. নবীজির সাথে মক্কা ত্যাগ করে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন তখন তিনি সাথে করে তখন তিনি সাথে করে সব টাকা-পয়সা নিয়ে গেলেন। যার ছিল প্রায় ৫০০ মুদ্রা বা ৬০০ মুদ্রার মতো।
আবু কুহাফা তখন খুব বৃদ্ধ ছিলেন। তাই তিনি চোখে খুব কম দেখতেন। তিনি তার নাতি অর্থাৎ আবু বকর রা. এর মেয়ে আসমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি সব কিছু নিয়ে চলে গেছে?
আসমা রা. বললেন, না। তিনি তো আমাদের জন্য কিছুটা রেখে গেছেন।
তখন আসমা রা. ঘরের এককোণে কিছু কঙ্করের টুকরো কাপড়ে মুড়িয়ে রাখলেন। এরপর তিনি আবু কুহাফার হাত সেখানে বুলিয়ে দিলেন। তখন আবু কুহাফা বললেন,
তাহলে তো সে তোমাদের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছে। এতে তোমাদের দিন চলে যাবে।
আবু কুহাফার ইসলাম গ্রহণ
মক্কা বিজয়ের দিন আবু কুহাফা তার ছোট মেয়ের সাথে পাহাড়ের উপরে উঠে মেয়েকে বললেন, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? সে বললো, একটি সুশৃঙ্খল দল এগিয়ে আসছে। তারা নিজের পতাকা উত্তোলন করে সামনে অগ্রসর হচ্ছে।
এরপর আবু কুহাফা বাড়ি ফেরার আগেই মুসলিম বাহিনীর সামনে পড়ে গেল। আবু বকর রা. তখন তার পিতার নিকট এগিয়ে আসলেন। তিনি তখন তাকে রাসূল সা. এর নিকট নিয়ে গেলেন।
রাসূল সা. তার বুকে হাত রেখে বললেন, ইসলাম গ্রহন করে নিজেকে সংশোধন করুন।
তখন আবু কুহাফা রা. ইসলাম গ্রহন করলেন।
মৃত্যু
আবু বকরের বাবা প্রায় ৯৭ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। তিনি খলিফা ওমর রা. যামানায় ইন্তিকাল করেন। অর্থাৎ তার ছেলে আবু বকর রা. তার আগে ইন্তিকাল করেন।
আবু বকর রা. ১৩ হিজরী মোতাবেক ৬৩৪ খৃষ্টাব্দে মদীনায় ইন্তিকাল করেন। যখন আবু কুহাফা এই সংবাদ পেলেন তখন তিনি বললেন, এটা তো বড় একটি বিপর্যয়। এখন তার পরে কে খলিফা হয়েছে?
লোকেরা বললো, ওমর খলিফা হয়েছে।
তখন আবু কুহাফা বললেন, সে আবু বকরের সঙ্গী ছিল।
আবু বকর রা. এর মা সালমা বিনতে সাখর
হযরত সালমা বিনতে সাখর রা. ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আবু বকর রা. এর মা। তিনি মক্কার গুরুত্বপূর্ণ মহিলাদের একজন ছিলেন। লোকেরা তাকে উম্মুল খায়ের নামে চিনতো।
জন্ম
(তারিখ জানা যায় নি) তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন কুরাইশ বংশের অন্যতম শাখা গোত্র বনু তাইম গোত্রে।
বংশীয় নসব
উম্মুল খায়ের সালমার পিতার নাম হলো সাখর, তার পিতার নাম আমের, তার পিতার নাম আমর, তার পিতার নাম কা’ব, তার পিতার নাম সা’দ, তার পিতার নাম তাইম, তার পিতার নাম মুররা, তার পিতার নাম ফাহার, তার পিতার নাম মালেক।
এভাবে তার বংশ মক্কার অন্যতম বংশ, যাকে আমরা হাশেমী বংশ বলি তাদের সাথে মুররার মাধ্যমে মিলেছে।
ইসলাম গ্রহণ
মক্কায় তখন সবেমাত্র ইসলাম প্রচার শুরু হয়েছে। সব মিলেয়ে মুসলমানদের সংখ্যা ত্রিশ বা পয়ত্রিশ জন। সে সময় একদিন আবু বকর রা. মসজিদে হারামে মানুষকে একত্ববাদ তথা ইসলামের দিকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন।
তখন উতবা ইবনে রাবিয়াহ্ আবু বকরের উপর হামলা করে।
এরপর তার সঙ্গীরা মিলে আবু বকরকে মারধর করে। এক পর্যায়ে তিনি আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
বনু তাইমের কিছু ব্যক্তি এসে তাকে চাদর দিয়ে ডেকে দেয়।
আবু বকর রা. কে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে আসার পর যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন আবু বকর রা. বলতে লাগলেন,
আল্লাহর রাসূলের কি অবস্থা?
উপস্থিত ব্যাক্তিরা বললো, তিনি কোথায় আছেন জানা নেই।
আবু বকর তখন বললেন, আমাকে তার নিকট নিয়ে চলো। সম্ভবত তিনি দারুল আরকামে আছেন।
এরপর রাতের অন্ধকারে আবু বকর রা. তার মায়ের সাথে রাসূলের নিকট গেলেন। আল্লাহর রাসূলকে দেখে আবু বকর রা. খুশী হয়ে বললেন,
হে আল্লাহর রাসূল! ইনি আমার মা। তার জন্য দোয়া করুন এবং তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে উদ্ধার করুন।
আল্লাহর রাসূল তখন সালমা বিনতে সাখরকে ইসলামের পথে আহবান করেন। তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
মৃত্যু
হযরত আবু কুহাফা রা. এর মতো সালমা বিনতে সাখরও দীর্ঘ হায়াত লাভ করেন।
সালমা বিনতে সাখর ১৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন।৪ সে সময় খলিফা ছিলেন আবু বকর রা.।
অন্য এক একটি মত অনুযায়ী তিনি ওমর রা. এর খেলাফতকালে ইন্তিকাল করেন।
আবু বকর রা. মৃত্যুবরণ করার পর তার সম্পদের মিরাস বা উত্তরাধিকারী হিসেবে তার পিতাও সম্পদ পান।
কেউ বলেন, তার মা তখন জীবিত ছিল। তিনিও সম্পত্তি লাভ করেন।
আবু বকর রা. এর স্ত্রী-সন্তানগণ
হযরত আবু বকর রা. ছিলেন মক্কার জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন। তিনি যেমন সম্ভ্রান্ত পরিবারের ব্যক্তি ছিলেন, তেমনি তার পরিবার-পরিজনও সম্ভ্রান্ত ছিল।
তিনি বিয়ে করেছিলেন ৪ টি। তার সন্তান ছিল মোট ছয়জন। তাদের মধ্যে তিনজন ছেলে এবং তিনজন মেয়ে।
আবু বকর রা. এর স্ত্রীদের পরিচয়
১. কাতিলা বিনতে আবদিল উজ্জা
তিনি ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ও আসমা রা. এর মা। তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে মতানৈক্য আছে। জাহেলী যুগেই আবু বকর রা. তাকে তালাক দিয়েছিলেন।
মদীনায় হিজরতের পর একবার তিনি তার কন্যা আসমা রা. এর নিকট পনির নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আসমা রা. তাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেন নি।
তিনি আয়েশা রা. কে নবীজির নিকট এই বলে পাঠান যে, মায়ের হাদিয়া নেয়া যাবে কিনা?
নবীজি বললেন, “তাকে ঘরে আসতে দাও এবং হাদিয়া গ্রহণ করো।”
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা মুমতাহিনার ৮ নং আয়াত অবতীর্ণ করেন,
“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখাতে ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।”
২. উম্মে রুমান বিনতে আমের রা.
তিনি হলেন বনু কিনানা ইবনে খুজায়মার মেয়ে। তার প্রথম স্বামী হারিস ইবনে সাখরা মক্কায় ইনতিকাল করলে আবু বকর রা. তাকে বিয়ে করেন।
উম্মে রুমান ইসলামের প্রাথমিক যুগেই মুসলমান হয়েছিলেন। রাসূলের নিকট বায়আত গ্রহণ এবং মদীনায় হিজরত ও করেছিলেন।
তিনি হযরত আব্দুর রহমান রা. ও আয়েশা রা. এর মা। ষষ্ঠ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। ৩
৩. আসমা বিনতে উমায়েস রা.
তার উপনাম উম্মে আব্দুল্লাহ। মুসলমানগণ দারুল আরকামে যাওয়ার আগেই তিনি বাইয়াত গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম হিজরতকারী একজন মহিলা।
তার প্রথম স্বামী জাফর ইবনে আবি তালেব রা. মুতার যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তিনি আবু বকর এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
বিদায় হজ্জের দিন তার গর্ভে মুহাম্মাদ বিন আবু বকর জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আবু বকর রা. ১৩ হিজরীতে ইন্তিকাল করলে তিনি আলী রা. এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ৪
৪. হাবিবা বিনতে খারিজা রা.
তিনি আনসারদের বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের মেয়ে। মদীনার পার্শ্ববর্তী সুনাহ নামক গ্রামে তিনি বসবাস করতেন। আবু বকর রা. এর ইন্তিকালের পর তার গর্ভে উম্মে কুলসুম জন্মগ্রহণ করেন। ৫
আবু বকর রা. এর সন্তানদের পরিচয়
১. আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর রা.
তিনি ছিলেন তার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। হুদাইবিয়ার দিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আজীবন তিনি ইসলামের উপর দৃঢ়পদ ছিলেন।
রাসূলের সাহাচর্যে ধন্য হয়েছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
আবু বকর এর খেলাফতকালে মুরতাদদের দমনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর রা.
তিনি হিজরতের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দিনভর মক্কার অলিতে গলিতে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে রাতে গোপনে সেই সংবাদ নবীজি ও আবু বকর রা. এর নিকট পৌছে দিতেন।
তায়েফের যুদ্ধে তিনি আহত হন। পরবর্তীতে সেই ক্ষতস্থান আর সেরে উঠে নি। আবু বকর এর শাসনামলে তিনি (১১ হিজরী) ইন্তিকাল করেন।
৩. মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর রা.
তিনি বিদায় হজ্জের দিন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কুরাইশের একজন ব্যক্তিত্ববান নওজোয়ান। আমিরুল মুমিনীন আলী রা. তাকে লালন পালন করেন।
আলী রা. তাকে মিসরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি শহীদ হন।
৪. আসমা রা.
তিনি বয়সে আয়েশা রা. এর বড়। হিজরতের সময় নবীজি মশকের মুখ আটঁকানোর জন্য কোনো কিছু না পাওয়ায় তিনি তার উড়না দুই টুঁকরো করে মশকের মুখ বেঁধে দেন।
তাই নবীজি তাকে যাতুন নিকাতাইন উপাধী দেন। যুবায়ের উবনে আওয়াম রা. এর সাথে তার বিয়ে হয়। পরবর্তীতে গর্ভবস্থায় তিনি হিজরত করেন।
মদীনায় তার গর্ভে আব্দুল্লাহ রা. জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মুহাজিরদের মধ্যে প্রথম সন্তান।
আসমা রা. প্রায় শত বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এত বয়ষ্ক হওয়ার পরও তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয় নি এবং দাঁত নড়ে নি।
তিনি রাসূলের থেকে ৫৬ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার থেকে ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, উরওয়া ইবনে যুবায়ের রা. প্রমুখ হাদীস বর্ণনা করেছেন।
৫. আয়েশা সিদ্দিকা রা.
তিনি নবীজির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন তিনি। নবীজি তাকে উম্মে আব্দুল্লাহ উপনাম দিয়েছিলেন।
তিনি নবীজির থেকৈ ২২১০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইন্তিকালের সময় তার বয়স ছিল ৬৩ বছর কয়েক মাস। ৫৭ হিজরীতে তিনি ইন্তিকাল করেন।
৬. উম্মে কুলসুম বিনতে আবু বকর রা.
উম্মে কুলসুম রহ. জন্মগ্রহণ করেন তার বাবার মৃত্যুর পর। তার মা ছিলেন খাজরাজ গোত্রের মেয়ে হাবিবা বিনতে খারিজা রা.।
পরবর্তীতে উম্মে উলসুম রহ. এর সাথে বিয়ে হয় তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রহ. এর সাথে। তিনি জঙ্গে জামালের যুদ্ধে শহীদ হন।
আবু বকর রা. ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কেমন ছিলেন
নবী সা. বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে জাহেলী যুগে উত্তম ছিল, ইসলাম গ্রহণের পরেও তারা উত্তম। যদি তারা ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয়”
হযরত আবু বকর রা. ছিলেন আরবের সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন। তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষিত, সম্রান্ত, আত্মমর্যাদাসম্পূর্ণ ব্যক্তি।
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের একজন আবু বকর রা.
আরবে সে সময় কোনো রাজা বা মন্ত্রী ছিল না। এখানে সমাজ পরিচালিত হতো গোত্রের মাধ্যমে। প্রতিটি গোত্রই ছিল শক্তিশালী। তাই ক্ষেত্রবিশেষে সবাই দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইতো।
কিন্তু সবাই দায়িত্ব নিলে তো পরিবেশ ঠিক থাকবে না। তাই বংশের প্রধানরা আলোচনার মাধ্যমে কিছু ব্যক্তিদের আলাদাভাবে বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত করেন।
বনু তাইম গোত্র থেকে হযরত আবু বকর রা. দায়িত্ব ইসলাম গ্রহণের পূর্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন জরিমানা আরোপন ও রক্তপণের সম্পদ রক্ষক।
তিনি যদি কখনো কারো জামিন হতেন তাহলে কুরাইশরা বিনাবাক্যে তা মেনে নিত। কিন্তু অন্য কারো বেলায় কুরাইশরা মানতো না।
জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন আবু বকর রা.
আরবে সে সময় সর্বোচ্চ জ্ঞান হিসেবে ধরা হতো ইলমুল আনসাব বা বংশ তালিকার জ্ঞান। মানুষ নিজেদের বংশ তালিকা বলাকে মনে করতো, অনেক বড় কিছু।
প্রাচীন আরবের ব্যাপারে তো এমন ঘটনাও পাওয়া যায় যে, অনেকে নিজের উটের বংশ তালিকা পর্যন্ত বলতে পারতো।
আবু বকর বংশ তালিকার জ্ঞান তথা ইলমুল আনসাব বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। মানুষ যখন সম্পদ বন্টনের সময় বংশ তালিকা প্রয়োজন পড়তো প্রাচীন আরবের নীতি অনুযায়ী,
আবু বকর রা. এর নিকট আসলে তিনি তাদের বংশ পরিচয় বলে দিতেন। তিনি যখন আরো বংশের ব্যাপারে উল্লেখ করতেন তখন অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের ন্যায় বংশের খারাপ ব্যক্তিদের হেয়-প্রতিপন্ন করতেন না।
তিনি ছিলেন বিখ্যাত ইলমুল আনসাব বিশারদ আকিল ইবনু আবি তালিব, মুযআর যুবাইরি এবং যুবাইর ইবনে মুতয়িম প্রমুখ ব্যক্তিদের শিক্ষক।
নবীজি সা. হাসসান ইবনে সাবেত রা. কে বলেছেন, তুমি আবু বকরের কাছ থেকে ইলমুল আনসাব শিক্ষা করো। কেননা তিনি আরবের কওমসমূহের বংশ পরিচয় সম্বন্ধে অধিক জ্ঞানী।
হযরত আয়েশা রা. বলেন,
নিঃসন্দেহে তিনি কুরাইশদের মধ্য থেকে তাদের বংশ তালিকা সম্পর্কে সর্বাধিক বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন।
ব্যবসায়ী হিসেবে আবু বকর রা.
ইসলাম আসার পূর্বে আরবের লোকেরা ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। আরবের প্রতিটি গোত্রই কোনো না কোনোভাবে ব্যবাসার সাথে জড়িত ছিল।
হযরত আবু বকর রা. ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ছিলেন একজন খ্যাতিমান ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসার জন্য শাম, বসরাসহ আরো বিভিন্ন স্থানে পণ্য নিয়ে যেতেন।
তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সে সময় মক্কার খ্যাতিমান ব্যবসায়ীদের সাথে তার উঠাবসা ছিল। হযরত খাদীজা রা. যেই মহল্লায় বসবাস করতেন আবু বকর ও সেই মহল্লায় বসবাস করতেন।
আবু বকর ব্যবসার পুঁজি ছিল ৪০ হাজার দিরহাম। যা বর্তমান বাংদেশের বাজার মূল্য হিসেবে ১৫,৬০০,০০০ টাকা।
জাহেলী যুগ থেকে তিনি মেহমানদারিতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। গরীব-অসহায়দের জন্য তিনি উদারচিত্তে খরচ সম্পদ খরচ করতেন।
তিনি কখনো মদপান করেন নি
আবু বকর ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও কখনো মদপান করেন নি। একবার এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি জাহেলী যুগে মদপান করেছেন?
তিনি বললেন, আমি এ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি।
লোকটি তখন জিজ্ঞাসা করলো, কেন আপনি পান করেন নি?
তিনি বললেন, নিজ সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার খাতিরেই আমি এ থেকে দূরে থেকেছি। যে ব্যক্তি মদপান করে, সে তার সম্মান-সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলে।
হযরত আয়েশা রা. বলেন, আবু বকর ও উসমান রা. জাহেলী যুগেও মদপান থেকে দূরে ছিলেন।
তিনি কখনো মূর্তিপূজা করেন নি
হযরত আবু বকর কখনো কোনো প্রতিমার পূজা করেন নি। সাহাবাদের এক মজলিসে তিনি বলেছেন, শৈশবে আমার পিতা আবু কুহাফা আমার হাত ধরে এক দেবালয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন,
এই উঁচু মূর্তিটি তোমার মাবুদ। এরপর তিনি আমাকে সেখানে রেখে কাজে চলে যান। আমি তখন মূর্তির কাছে গিয়ে বলি,
আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে খাবার দাও। কিন্তু মূর্তি কোনো সাড়া দেয় নি। এরপর আমার বলি, আমার জামা-কাপড় নেই। আমাকে জামা-কাপড় দাও। এবারও সে কোনো জবাবা দেয় না।
তখন আমি একটা পাথর উঠিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারলে সেটা ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়।
আবু বকর রা. এর ইসলাম গ্রহণ
আবু বকর রা. এর ইসলাম গ্রহণ ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফলাফল। শুরু থেকেই তিনি সত্য ধর্ম খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
এ জন্য তিনি তৎকালীন কয়েকজন বড় বড় খৃষ্টান পন্ডিতের গমন করেন। তারা তাকে সুসংবাদ দেন এক মহান ধর্মের।
যেই ধর্ম আরবের এক ব্যক্তির হাত ধরে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আর তিনিই হবেন শেষ নবী। আবু বকরের এর এই দীর্ঘ সফর হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা তার থেকেই বর্ণনা করছি।
উমাইয়া ইবনে আবিস
একবার আমি কা’বার আঙ্গিনায় বসে ছিলাম। আমার পাশে ছিলেন যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল। তখন পাশ দিয়ে উমাইয়া ইবনে আবিস যাচ্ছিলেন।
তিনি তখন আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, সকালটা কেমন কাটঁলো?
জায়েদ জবাব দেন, কল্যাণ ও সুস্থতার সঙ্গে।
উমাইয়া তখন প্রশ্ন করলেন, কল্যাণ কি পেয়ে গেছ?
যায়েদ বিন আমর বললেন, না।
তখন উমাইয়া বললেন, কেয়ামতের দিন ইব্রাহীম আ. এর দ্বীন ব্যতিত সবগুলোই পরিত্যাজ্য হবে। কিন্তু কথা হলো, প্রতীক্ষিত নবী কি তোমাদের মধ্য থেকে (কুরাইশদের মধ্য থেকে) হবে নাকি আমাদের মধ্য থেকে (ইসহাক আ. এর বংশধরদের মধ্য থেকে)।
ওয়ারাকা ইবনে নাওফালের নিকট
ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল ছিলেন একজন নীতিবান ও ধর্মপ্রাণ খৃষ্টান। তিনি অধিকাংশ সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় বিভোর থাকতেন।
তিনি তার নিকট উমাইয়া ইবনে আবিসের কথোপকথন তুলে ধরলেন। তখন ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল বললেন,
হ্যাঁ বেটা। আমরা কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ধারণ করি। জেনে রেখো, যে নবীর অপেক্ষা করা হচ্ছে, তিনি আরবের শ্রেষ্ঠ বংশে আবির্ভূত হবেন।
আমি আরবের বংশ তালিকা সম্পর্কে জানি। সেই হিসেবে তিনি কুরাইশদের মধ্যেই আবির্ভূত হবেন।
তখন তিনি ওয়ারাকাকে তাকে প্রশ্ন করলেন, সেই নবী কি বলবেন?
ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল বললেন, তিনি সেটাই বলবেন, যা আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিবেন। তিনি যুলুম করবেন না এবং অন্যকেও যুলুমের আদেশ দিবেন না।
শামে অবস্থানকালে স্বপ্ন
আবু বকর রা. ব্যবসায়িক কাজে প্রায় বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়া করতেন। সেই সুবাদে একবার তিনি শামে গমন করেন।
সেখানে তিনি একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন। পরবর্তীতে তা পাদ্রী বুহাইরার কাছে তিনি বর্ণনা করেন। পাদ্রী বুহাইরা হলেন একটা ধার্মিক খৃষ্টান।
তিনি বসবাস করতেন শামের পাশেই। সেখানে একটি ইবাদতখানায় তিনি বসবাস করতেন। পাদ্রী বুহাইরার ব্যাপারে সীরাতের কিতাবে উল্লেখ আছে।
পাদ্রী বুহাইরা স্বপ্ন শোনার পর আবু বকরকে বললেন, আপনি কোথায় থাকেন?
তিনি জবাব দেন, মক্কায়।
: কোন গোত্রে?
: কুরাইশ গোত্রে।
: কি কাজ করেন আপনি?
: ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি।
তখন বুহাইরা বললেন, আপনার বক্তব্য সঠিক হয়ে থাকলে আপনার গোত্রে একজন নবী আসবেন। আর আপনি সেই নবীর জীবদ্দশায় তার প্রধান সহচর এবং ইন্তিকালের পর সেই নবীর খলিফা হবেন।
আর এই বিষয়ে কাউকে বলবেন না। গোপন রাখবেন।
মুহাম্মাদ সা. এবং আবু বকর রা.
৪০ বছর বয়সে নবীজি প্রথম ওহীপ্রাপ্ত হলেন। তিনি স্রষ্টার পক্ষ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলেন। মানুষের নিকট পৌঁছে দিলেন সাম্যের বাণী।
সর্বপ্রথম তিনি জানালেন তার স্ত্রী খাতিজা রা. এর নিকট। খাদিজা রা. সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে নবীজি জানান তার বিশ্বস্ত বন্ধু, আবু বকর রা. কে। তিনিও সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে নেন। কোনো প্রশ্ন করেন নি।
আবু বকর রা. পূর্বেই জানতেন একজন নবী আসবে। কিন্তু তিনি কে হবেন, তা জানা ছিল না। যেহেতু আবু বকর এবং মুহাম্মাদ সা. একসাথে বড় হয়েছেন, একসাথে বেড়ে উঠেছেন।
তাই কখনো কখনো তিনি ভাবতেন, হতে পারে সেই প্রতীক্ষিত নবী মুহাম্মাদ ই হবে। কারণ, তার চাল-চলন এবং আচার ব্যবহার সেটাই সাক্ষ্য দেয়।
সিরাতের কিতাবে এই ঘটনা এভাবে উল্লেখ আছে, নবীজি আবু বকরকে দাওয়াত দেন এভাবে,
আমি আল্লাহর নবী। আমাকে আল্লাহ এই দাওয়াত দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, কেবল আল্লাহর ইবাদত করো। তার সঙ্গে কাউকে শরীক করো না।
তিনি ব্যতীত কারো ইবাদত করো না এবং তার আনুগত্য করো ও তার উপর ভালোবাসা স্থাপন করো।
তখন আবু বকর রা. কোনো কথা না বলে সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে নেন।
আবু বকর রা. এর ইসলাম গ্রহণের পরবর্তী জীবন
ইসলাম গ্রহণের পর আবু বকর রা. ইসলামের দাওয়াত নিজে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌছে যান। তখনো এই ধর্মের এতটা প্রচার-প্রসার হয় নি। সবেমাত্র শুরু হলো।
আবু বকর রা. যেহেতু ব্যবসায়ী ছিলেন, সেই সুবাদে তার সাথে আরো বেশ কিছু বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর পরিচয় ছিল। তিনি তাদেরকে সাম্যের পথে আহবান করলেন।
তাদেরকে এক আল্লাহর দিকে ডাকলেন। মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে নিরাকার আল্লাহর ইবাদত করতে বললেন।
আবু বকর রা. এর এই দাওয়াতি কার্যক্রমে আরো অনেক মহান ব্যক্তিরা এই নূরানী কাফেলায় শামিল হলো। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন হলেন,
যুবায়ের ইবনে আওয়াম রা., উসমান ইবনে আফফান রা., তালহা বিন উবায়দুল্লাহ রা., সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা., আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা.,
উসমান ইবনে মাজউন রা., আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা., আবু সালামা ইবনে আবদিল আসাদ রা, আরকাম রা, প্রমুখ সাহাবারা।
আবু বকর রা. খুবই বুদ্ধিদীপ্তভাবে তাদেরকে দাওয়াত দেন। তিনি তাদের প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে রাসূলের নিকট উপস্থিত করেন।
তারাই ছিলেন ইসলামের প্রথম স্তম্ভ। তাদের মাধ্যমেই ইসলাম আরো ব্যাপকভাবে মানুষের নিকট পৌছে গিয়েছে। এ সময় ধীরে ধীরে আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন।
নিজ পরিবারকে দাওয়াত
অন্যকে ভালো কাজের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি নিজের পরিবারকেও সংশোধন করা একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ।
তেমনি হযরত আবু বকর রা. ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে নিজের পরিবারকেও অনেক সময় দেন।
এর ফলে তার কন্যা আসমা এবং আয়েশা রা., তার স্ত্রী উম্মে রুম্মান, ছেলে আব্দুল্লাহ, নিজের খাদেম আমির ইবনে ফুহাইরা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন।
কাফেরদের নির্যাতন
মক্কায় যখন চুপি চুপি ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম চলতে লাগলো তখনই মুসলমাদের উপর শুরু হলো নির্যাতন।
চির পরিচিত ধর্মকে ত্যাগ করে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসীরা মক্কার মূর্তিপূজকদের নিকট ছিল পথভ্রষ্ট এবং স্ব-ধর্মত্যাগী।
তারা এটা মেনে পারে নি। তাই তারা মুসলমানদের ধর্মত্যাগের অফার দেয়। কিন্তু যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তারা কি দুনিয়ার সামান্য প্রলোভনে ধর্মত্যাগ করবে?
শেষ পর্যন্ত কাফেররা বুঝতে পারলো, এরা আর ইসলাম ত্যাগ করবে না। পরিশেষে তারা নির্যাতনের দিকটি বেছে নিল।
হযরত আবু বকর রা. নবীজির নিকট আবেদন করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে প্রকাশ্যে দাওয়াতের অনুমতি দিন।
নবীজির নিকট বারবার পীড়াপীড়ি করার কারণে তিনি অনুমতি দেন।
নবীজি তখন সাহাবাদের নিয়ে কা’বার চত্বরে যান। এরপর স্ব স্ব গোত্রের নিকট বসেন। তখন আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে ভাষণ দেয়া শুরু করলেন।
তিনি মানুষকে নিরাকার আল্লাহর পথে ডাকছিলেন। মূর্তিপূজা ত্যাগ করে মানুষকে ইসলামের পথে আহবান করছিলেন।
এই বক্তব্য শুনে মূর্তিপূজক কাফেররা ক্ষিপ্ত হয়ে আবু বকর এবং উপস্থিত সাহাবাদের উপর হামলা করে। তারা আবু বকরকে এমনভাবে লাথি মারতে থাকে যে, তার নাক ফেঁটে রক্ত ঝরছিল।
আবু বকর রা. এর এমন অবস্থা দেখে বনু তাইমের লোকেরা দৌঁড়ে আসলো। তারা আবু বকরকে বাড়িতে নিয়ে যায়।
আবু বকর রা. তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। তার হুশ ছিল না।
জ্ঞান ফেরার পর
যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন আবু বকর রা. বললেন, নবীজি কেমন আছেন?
এ কথা শুনে লোকেরা তাকে ভৎসনা করতে করতে চলে যায়। তার মা তখন পাশে বসে কিছু খাবার খেতে পীড়াপীড়ি করলেন।
তখন আবু বকর বললেন, আল্লাহর কসম! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত খাবো না যতক্ষণ না আমি রাসূলের খবর জানতে পারবো।
তখন আবু বকরের মা সালমা বিনতে সাখর উম্মে জামিলের নিকট গিয়ে বললেন, আবু বকর মুহাম্মাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়। তখন উম্মে জামিল সতর্কতাবশত বললো,
আমি তো মুহাম্মাদ কিংবা আবু বকর কাউকেই চিনি না। তবে আপনি চাইলে আপনার ছেলের নিকট যেতে পারি। উম্মে জামিল আবু বকরের নিকট আসার পর আবু বকরের খারাপ অবস্থা দেখে বললেন, যারা আপনার উপর এমন অত্যাচার করেছে, তারা জঘন্য কাফির।
তখন উম্মে জামিল বললেন, নবীজি ভালো আছেন এবং সুস্থ আছেন।
আবু বকর জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় আছেন এখন তিনি? উম্মে জামিল বললেন, আরকাম রা. এর বাড়িতে আছেন।
রাতে আবু বকর উম্মে জামিল এবং সালমা বিনতে সাখরের সাথে দারুল আরকামে গেলেন। নবীজি আবু বকরকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন।
তখন আব বকর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইনি আমার মা। তার জন্য হেদায়াতের দোয়া করুন।
এরপর আবু বকরের মা সালমা বিনতে সাখর ইসলাম গ্রহণ করেন।
আবু বকরের প্রতিরোধ এবং কাফেরদের হামলা
রাসূল সা. যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, মানুষকে তিনি ইসলামের পথে আহবান করতে লাগলেন তখনই কাফেররা রাসূলের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধাচারণ শুরু করলো।
তারা রাসূলকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিত। কখনো বা তাকে গালি-গালাজ করতো। কখনো বা তাকে প্রহার করতো। এত এত নির্যাতনের মধ্যেও রাসূল কখনো মানুষকে দ্বীনের পথে আহবান করা থেকে বিরত থাকেন নি।
হযরত আবু বকর রা. সর্বদা রাসূলের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি কাফেরদের অত্যাচার থেকে রাসূলকে সর্বদা হেফাজত করার চেষ্টা করতেন।
উরওয়া ইবনে যুবায়ের রা. বলেন,
আমি একবার আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আসকে প্রশ্ন করি, রাসূলের সঙ্গে মুশরিকদের সবচেয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ অসদাচরণ কি ছিল?
জবাবে তিনি বললেন, একবার রাসূল সা. কা’বার প্রাঙ্গনে নামাজ পড়ছিলেন। এ সময়ে উকবা ইবনে আবু মুইত সেখানে আসে।
সে তার কাপড় রাসূলের গলায় পেঁচিয়ে অত্যন্ত কঠিনভাবে টেনে ধরে। সে সময় হঠাৎ আবু বকর রা. সেখানে উপস্থিত হন।
তিনি উকবাকে রাসূলের নিকট হতে দূরে সরিয়ে দেন। আর বলেন,
তোমরা কি একটি লোককে কেবল এই কারণে হত্যা করতে চাচ্ছ যে সে বলে, আমার রব আল্লাহ।
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত,
একবার কিছু মুশরিকরা রাসূল সা. কে এতটা জঘন্যভাবে প্রহার করছিল যে, তিনি বেঁহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। তখন আবু বকর রা. তাদের বলতে থাকেন,
তোমরা ধ্বংস হয়ে যাও। তোমরা কি একটি লোককে কেবল এই কারণে হত্যা করতে চাচ্ছ যে সে বলে, আমার রব আল্লাহ।
তখন সেই মুশরিকরা তার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো, এই লোকটা আবার কে?
একজন বললো, সে আবু কুহাফার পুত্র। তারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সেও এই মুহাম্মাদকে অনুসরণ করে।
আসমা রা. থেকে বর্ণিত,
একবার মক্কার কাফেররা হারাম শরীফে বসে পরামর্শ করছিল। সে সময় তাদের একজন বললো, তোমরা কি জান যে, মুহাম্মাদ আমাদের দেব-দেবীকে অপমান করছে।
সেই সময় মুহাম্মাদ সা. তাদের পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তারা তাকে ডেকে বললো, অ্যাই মুহাম্মাদ! তুমি নাকি আমাদের দেব-দেবীদের নামে অপপ্রচার করছো?
নবীজি তখন স্বাভাবিকভাবেই বললেন, আমি তাদের ব্যাপারে যা বলেছি তা সঠিকই বলেছি।
এ কথা শুনে তারা নবীজির উপর হামলা করে। একজন ব্যক্তি আবু বকরের নিকট এসে এই সংবাদ দিল। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের নিকট গিয়ে বললেন,
তোমরা কি একটি লোককে কেবল এই কারণে হত্যা করতে চাচ্ছ যে সে বলে, আমার রব আল্লাহ।
আবু বকরের প্রতিরোধ এর ফলে কাফেররা মুহাম্মাদ সা. কে ছেড়ে আবু বকরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা তার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে।
তাকে অনেক নির্যাতন করে। এরপর যখন তিনি ঘরে ফিরে আসেন তখন দেখা গেল মাথায় হাত দিলেই হাতের সাথে চুল চলে আসতো।
আলী রা. একবার এক ভাষণে বললেন,
লোকসকল, তোমরা বলো তো, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাহাদুর কে?
লোকেরা তখন বললো, হে আমির, আপনিই তো সবচেয়ে বড় বাহাদুর। তখন তিনি বললেন,
যে আমার সাথে মোকাবেলা করতে এসেছি, তাকে আমি তার পাওনা আদায় করে দিয়েছি। অর্থাৎ তাকে খতম করে দিয়েছি।
কিন্তু সবচেয়ে বড় বাহাদুর হলেন আবু বকর রা.। কারণ, বদরযুদ্ধে যখন আমরা শামিয়ানা বানিয়ে রাসূলের বডিগার্ড হিসেবে কে থাকবে সেটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম,
তখন আবু বকর রা. ই তরবারি নিয়ে রাসূলের গার্ড হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। যখনই কোনো কাফের রাসূলের দিকে অগ্রসর হতো তখনই সে আবু বকরের তরবারির নিচে পড়তো।
কুরাইশরা যখন ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় রাসূলকে কষ্ট দিত তখন তিনিই শুধুমাত্র তার পাশে দাঁড়িয়ে কাফেরদের নির্যাতন থেকে রাসূলকে রক্ষা করতেন। আর তিনি বলতেন,
তোমরা ধ্বংস হও। তোমরা কি একটি লোককে কেবল এই কারণে হত্যা করতে চাচ্ছ যে সে বলে, আমার রব আল্লাহ।
মুসলমানদের জন্য আবু বকরের সম্পদ ব্যয়
দিন দিন ইসলাম মানুষের নিকট আরো সমাদৃত হতে লাগলো। মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করতে লাগলো মনেপ্রাণে। সাহাবারা নিজের জীবনের চেয়েও ইসলামকে দামী মনে করতো।
মক্কার মূর্তিপূজকরা যখন দেখলো, গরীব এবং গোলামরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে তখন তারা ভয় পেয়ে যায়।
তাই সর্বদা গরীব ও অসহায়দের ইসলাম ত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতো। এই ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ছিল গোলাম। যারা ছিল অন্যের মালিকানাধীন।
হযরত বেলাল রা.
তিনি ছিলেন একজন হাবশী সাহাবী। তিনি কোনো স্বাধীন পুরুষ ছিলেন না। ছিলেন একজন গোলাম বা দাস। তার মুনিব ছিল কট্টরপন্থি কাফের উমাইয়া ইবনে খালফ।
উমাইয়া ইবনে খালফ ছিল একজন কট্টর মুর্তিপূজক। কখনো যে কেউ মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলবে, এটা সে সহ্য করতে পারতো না।
সে বেলাল রা. কে ইসলাম ত্যাগ করার বিনিময়ে লোভনীয় অফার করলো। কিন্তু যার অন্তরে আল্লাহর ইসলামের তৃপ্তি দিয়ে দিয়েছেন, সে কি কখনো ইসলাম ত্যাগ করবে?
তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। শুরু হলো তার উপর নির্যাতনের স্ট্রীম রোলার। উমাইয়া ইবনে খালফ অন্য গোলামদের হুকুম দিলেন,
বেলালকে পাথরচাপা দিয়ে রাখ। তখন গোলামরা বেলালকে ধরে পাথরচাপা দিয়ে রাখলো। উমাইয়া ইবনে খালফ এগিয়ে এসে বললো,
যতক্ষণ না তুমি লাত ও উজ্জার পূজা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি এই শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।
একদিন আবু বকর রা. রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। বেলালকে এমন দুরবস্থায় দেখে উমাইয়া ইবনে খালফকে বললেন, এই লোকটির ব্যাপারে কি সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করবে না? আর কত এই লোকটিকে নির্যাতন করবে?
উমাইয়া ইবনে খালফ বলে, তোমরাই তো তাকে পথভ্রষ্ট করেছ। তাই মন চাইলে তাকে কিনে নাও।
আবু বকর রা. তৎক্ষণাৎ বেলাল রা. কে কিনে আজাদ করে দিলেন। আর উমাইয়া ইবনে খালফকে এর মূল্য বাবদ দিয়েছিলেন ৪০ উকিয়া স্বর্ণ। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। তবে বর্তমানে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দামটা আরো বেশি হবে।
আবু বকরের বদান্যতা
কাফেররা মুসলমানদের ধৈর্য এবং সহনশীলতা দেখে জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। তারা কোনোভাবেই এটা মানতে চাইতো না যে, আল্লাহ এক।
তারা নওমুসলিমদের উপর অত্যাচার করতো। তাদের উপর যুলুম নির্যাতন করতো অতিরিক্ত মাত্রায়। হযরত আবু বকর রা. তাদের নিকট হতে গোলাম মুসলমানদের ক্রয় করে নিতেন।
এতে তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো। আবু বকর রা. আরো যাদের ক্রয় করেছিলেন,
১. আমির ইবনে ফুহাইরা রা.।
২. উম্মে উবাইস রা.।
৩. জিন্নিরা রা.।
৪. নাহদিয়া রা. এবং তার কন্যা।
জিন্নিরা রা.
জিন্নিরা রা. ছিলেন অন্ধ একজন সাহাবী। সম্ভবত কাফেরদের নির্যাতনের কারণে তার দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছিল। তাই কাফেররা বলাবলি করতে লাগলো,
লাত উজ্জা তার দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে। তখন জিন্নিরা রা. বলেছিলেন, তোমরা মিথ্যা বলেছ। আল্লাহর শপথ! লাত ও উজ্জার কোনো ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা নেই।
পরিবেশে আল্লাহ তা’আলা জিন্নিরা রা. এর চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন।
নাহদিয়া রা. এবং তার কন্যা
তারা ছিলেন বনু আব্দুদ দারের এক মহিলার বাঁদি। আবু বকর রা. তাদেরকে ক্রয় করে মুক্ত করে দেয়ার সময় তারা তাদের পূর্বের মনিবের কাজ করছিল।
যখন আবু বকর রা. তাদেরকে মুক্তির সুসংবাদ দিলেন তখন তারা বললো, আমরা কি আমাদের হাতের কাজ শেষ করবো না?
আবু বকর রা. বললেন, তোমাদের ইচ্ছা।
এভাবেই আবু বকর রা. অনেক সাহাবাকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। তাদেরকে কাফেরদের নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছেন।
তখনো আবু বকরের পিতা উসমান বিন আমের আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তাই তিনি এভাবে গোলামদের কিনে আযাদ করে দেয়া পছন্দ করতেন না।
একবার তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এভাবে গোলামদের কিনে আযাদ করে দাও কেন? তাদেরকে ব্যবসায় লাগালে তো আরো লাভবান হতে।
তখন আবু বকর রা. বললেন, এটা এমন এক ব্যবসা, যার লাভ আরো অনেক বেশি।
আবিসিনিয়ায় আবু বকর রা. এর হিজরত
সবেমাত্র মক্কায় শত মানুষ নিজেকে আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করেছে। তারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে কিংবা কোনো ভালো কাজে মশগুল থাকে।
আবু বকর রা. ইসলামকে আরো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দিন-রাত চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কট্টরপন্থি মূর্তিপূজকরা বারবার বাঁধা দিতে লাগলো।
তারা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করতে লাগলো গণহারে। আবু বকর এবং নবীজির মতো সম্মানিত ব্যক্তিদেরকেও তারা কা’বার প্রাঙ্গনে মারধর করতো।
যেই নবীজি দীর্ঘ ৪০ বছর মক্কার মানুষদের নিকট আল-আমিন নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন, যিনি কারো সাথে কোনোরূপ ঝামেলায় জড়ান নি, তাকেও কাফেররা আজ ইসলাম প্রচারের কারণে গালিগালাজ করে, মারধর করে।
আবু বকর রা. এর মতো জ্ঞানী এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিকেও তারা এই নির্যাতন থেকে রেহাই দেয় নি। পরিস্থিতি ক্রমে ক্রমেই আরো ভয়াবহ হতে লাগলো।
এরইমধ্যে রাসূলের অনুমতিক্রমে কিছু সাহাবা হাবশায় তথা বর্তমান ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। কাফেরদের নির্যাতনে বাধ্য হয়ে আবু বকরও চাইলেন হিজরত করতে।
আবিসিনিয়ায় হিজরতের জন্য হযরত আবু বকর এর সিদ্ধান্ত
হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, আমার বাবা অর্থাৎ আবু বকর রা. হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। তিনি বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন।
বারকুল গিমাদ বর্তমানে সৌদি আবরের জেদ্দা শহরের একটি এলাকার নাম।
সেখানে তার সাথে কারাহ গোত্রের সরদার ইবনে দাগানার সাথে দেখা হয়। অনেক ইতিহাসবিদ ইবনে দাগানার মূল নাম হিসেবে উল্লেখ করেছেন,
হারিস ইবনে ইয়াজিদ। আবার কেউ বলেছেন তার নাম মালিক। কতক ঐতিহাসিক লিখেছেন, তার নাম রাবিআ বিন রাফি। আর কারাহ গোত্র হলো (হাওন ইবনে খুজাইমা) খুজাইমা গোত্রের শাখা গোত্র।
ইবনে দাগানা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আবু বকর! আপনি এত প্রস্তুত হয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
আবু বকর রা. জবাব দিলেন, আমার জাতি আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। আমি এমন কোথাও চলে যেতে চাই, যেখানে আমি স্বাধীনভাবে আমার রবের ইবাদত করতে পারবো।
এটা শুনে ইবনে দাগানা আঁতকে উঠলেন। বললেন, কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি তো অসহায়দের সাহায্য করেন। আত্মীয়দের খেয়াল রাখেন। আপনাকে আমি নিরাপত্তা দিচ্ছি। আপনি আমার সাথে মক্কায় চলুন।
পূনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তন
আবু বকর রা. ইবনে দাগানার সাথে মক্কায় ফিরে আসেন। ইবনে দাগানা তখন কুরাইশদের নেতৃবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন,
তোমরা কি আবু বকরের মতো এমন একজন গুণধর ব্যক্তিকে তাড়িয়ে দিচ্ছ, যিনি অভাবীদের সাহায্য করে এবং আত্মীয়দের খেয়াল রাখে?
যিনি অন্যের বোঝা উঠিয়ে নেন এবং বিপদগ্রস্তদের সহায়তা করেন?
কুরাইশরা তখন ইবনে দাগানার নিরাপত্তার প্রস্তাব মেনে নেয়। তবে তারা শর্ত জুড়ে দেয় যে, তিনি ঘরের বাহিরে কোনোরূপ ইবাদত করতে পারবেন না।
আবু বকরের কা’বার প্রাঙ্গনে আসা নিষেধ। মানুষকে তিনি তার ধর্মের দিকে আহবান করতে পারবেন না।
কারণ, আমরা আশংকা করি, তার ইবাদত দেখে অথবা তার কথায় আমাদের যুবক, নারী এবং বৃদ্ধরা মূর্তিপূজা ত্যাগ করবে।
হযরত আবু বকরের কার্যক্রম
আবু বকরের নিকট ইবনে দাগানা এই সংবাদ পৌঁছে দিলে তিনি ঘরেই ইবাদত করতে লাগলেন। ঘর থেকে বের হন না।
তখন তিনি বুদ্ধি করে তার বাড়ির আঙ্গিনায় একটি ছোট ইবাদতখানা নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি নামাজ এবং কুরআন তেলওয়াত করতে লাগলেন।
কুরাইশদের যুবক, নারী-পুরুষরা সেখানে দাঁড়িয়ে তেলওয়াত শ্রবণ করতো। কুরাইশরা এই পরিস্থিতি দেখে ভীত হয়ে গেল।
তারা ইবনে দাগানাকে বললো, আমরা আপনার কারণে আবু বকরকে তার অবস্থার উপরে ছেড়ে দিয়েছিলাম। শর্ত ছিল,
তিনি তার ঘরে নামাজ বা তেলওয়াত করবেন। কিন্তু তিনি শর্ত ভঙ্গ করে ঘরের বাহিরে ইবাদতখানা বানিয়ে সেখানে নামাজ এবং তেলওয়াত করছেন।
এর ফলে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। যদি সে এমন করতে থাকে তাহলে আপনি তার নিরাপত্তা উঠিয়ে নিন।
আবু বকরের নিকট ইবনে দাগানা এই কথা বলার পর আবু বকর বললেন,
ঠিক আছে। আপনি জিম্মাদারী উঠিয়ে নিন। আল্লাহর নিকট আমি নিরাপত্তা কামনা করছি।
নিরাপত্তা উঠিয়ে নেয়ার পর
ইবনে দাগানা নিরাপত্তা উঠিয়ে নেয়ার পর একবার কা’বার প্রাঙ্গনে গেলেন। তখন কুরাইশদের একজন ব্যক্তি আবু বকরের মাথায় মাটি ঢেলে দেয়।
তখন আবু বকরের পাশ দিয়ে ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা অতিক্রম করছিল। আবু বকর তাকে বললেন, দেখুন সে কি কাজটি করলো!
ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা বললো, এটা তো তোমার কর্মফল। তখন আবু বকর এই কথা বলতে বলতে চলে গেলেন, আমার সৃষ্টিকর্তা কতই না ধৈর্যশীল!
মদীনায় আবু বকর এর হিজরত
মক্কায় কাফেরদের নির্যাতন ক্রমে ক্রমেই বাড়তে লাগলো। প্রায় ৭০ জনের মতো মুসলমান কাফেরদের নির্যাতন থেকে মুক্তিলাভের আশায় হাবশা তথা ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন।
কিছু মুসলমান তখনো মক্কায় অবস্থান করছিলেন। কেউ বা মক্কার আশেপাশে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবু বকর রা. একবার হাবশায় হিজরত করতে গিয়েও ফিরে এসেছেন।
কিন্তু ফিরে আসার পর কাফেরদের নির্যাতন আগের চেয়েও বেড়ে গেল। তিনি নবীজিকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল!
আমাকে অন্যান্য সাহাবীর মতো মদীনায় হিজরতের অনুমতি দিন।
রাসূল সা. তখন তাকে বললেন, তাড়াহুড়ো করো না। সম্ভবত আল্লাহ তোমাকে আমার সঙ্গে হিজরতের সৌভাগ্য দান করবেন।
মদীনায় হিজরতের অনুমতি
হযরত আয়েশা রা. তখনকার ঘটনাটা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূল সা. সকাল কিংবা সন্ধায় একবার হলেও আমাদের বাসায় আসতেন।
কিন্তু যেদিন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতিপ্রাপ্ত হন সেদিন দুপুরেই চলে আসেন আমাদের বাসায়।
অসময়ে আবু বকর রা. নবীজিকে আসতে দেখে বলে উঠলেন,
নিশ্চয় বড় কোনো ঘটনা ঘটে গেছে। নবীজি ঘরে প্রবেশ করার পর আবু বকর রা. খাট থেকে নেমে যান।
তখন সেই ঘরে আবু বকর, আয়েশা এবং আসমা রা. ছিল।
রাসূল সা. আবু বকরকে বললেন, তুমি ছাড়া বাকিদেরকে অন্য ঘরে যেতে বলো। আবু বকর রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল!
ব্যাপার কি? এখানে তো কেবল আমার মেয়েরাই আছে। নবীজি তখন বললেন, হিজরতের অনুমতি পাওয়া গেছে। আর তুমি আমার সাথে যাবে।
এই সূসংবাদ শুনে আবু বকর রা. কেঁদে ফেললেন।
আয়েশা রা. এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আনন্দে যে কেউ কখনো ক্রন্দন করে, তা আমি আগে জানতাম না।
এরপর আবু বকর রা. দুইটি উট নিয়ে এসে নবীজিকে দিয়ে বললেন, এর একটি আপনার। নবীজি তখন বললেন, আমি পারিশ্রমিক আদায়ের শর্তে নিতে রাজী আছি।
প্রস্তুতি
হযরত আবু বকর রা. এর পরিবার সফরের মালসামানা প্রস্তুত করেন। কিভাবে এবং কোন রাস্তা ধরে অতিক্রম করবেন, সেটাও ভেবে নেন তারা।
বনু আদি গোত্রের অন্যতম শাখা হলো বনু দাইল। এই দাইল গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উরাইকিত নামক এক ব্যক্তিকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পথপ্রদর্শক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
সে ছিল মূলত মূর্তিপূজক। কিন্তু বিশ্বস্ত ছিল। কিভাবে কখন এবং কোন জায়গা থেকে সে আবু বকর এবং নবীজিকে নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে গমন করবে, তা আগেই ঠিক করা হয়।
এরপর কাঙ্খিত মূহুর্তে নবীজি এবং আবু বকর রা. বেরিয়ে পড়েন। তারা মক্কা থেকে তিন মাইল দক্ষিণ পূর্বে সাওর পাহাড়ের গুহায় অবস্থান করেন।
এই পাহাড়ের উচ্চতা হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৪৮ মিটার। নবীজি এবং আবু বকর রা. প্রায় তিনদিন এই পাহাড়ে আত্মগোপন করে থাকেন।
আত্মগোপন থাকাকালীন অবস্থা
একদিন হঠাৎ কাফেররা দেখতে পেল, নবীজি এবং আবু বকর কেউই মক্কায় নেই। অনেক খোঁজাখুজি করেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। শুরু হলো তাদের তল্লাশী।
হযরত আবু বকর রা. এর সন্তান আব্দুর রহমান রাতের আধাঁরে সাওর গুহায় চলে যেতেন আবার ভোরের আলো ফোঁটার পূর্বেই মক্কায় চলে আসতেন।
এতে মনে হতো, তিনি মক্কায় অবস্থান করছেন। তিনি নবীজিকে এবং আবু বকরকে সারাদিন মক্কায় ঘটে যাওয়া সংবাদগুলো বলতেন।
রাত কিছুটা গভীর হলে আবু বকর রা. এর গোলাম আমির বিন ফুহাইরা বকরির পাল নিয়ে সাওর গুহায় চলে যেতেন। সেখানে তারা বকরির দুধ পান করে নিজেরেদ ক্ষুধা নিবরণ করতেন।
মুশরিকরা আবু বকর এবং নবীজিকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। তাদের একটি দল সাওর গুহার নিকটে চলে আসে। কিন্তু তারা ধোঁকায় পড়ে যায়।
আবু বকর রা. তখন কম্পিত কণ্ঠে বললেন, কাফেররা যদি তাদের পায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাহলে আমাদের সহজেই দেখে ফেলবে।
নবীজি তখন বললেন, ভয় পেয়ো না। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।
মদীনায় যাত্রা
অবশেষে কাফেররা নিরাশ হয়ে ফিরে গেল। তিনদিন পর আব্দুল্লাহ ইবনে উরাইকিতের সাথে নবীজি এবং আবু বকর সফরে বেরিয়ে পড়েন।
সে মক্কা থেকে মদীনায় যাওয়ার পরিচিত পথে না গিয়ে অপরিচিত একটি পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে। অবশেষে নবীজি এবং আবু বকর রা. মদীনায় পৌঁছলেন।
মদীনায় আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। মানুষ দলে দলে বের হয়ে সম্ভাষণ জানাতে লাগলো। ছোট্ট শিশুরা গাইতে লাগলো,
طلع البدر علينا
পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের উপর(কাছে) এসেছে
من ثنيات الوداع
ওয়া’দা‘ উপত্যকা থেকে (যে উপত্যকা দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (দ.) মদিনায় প্রবেশ করেন)
وجب الشكر علينا
এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য
ما دعى لله داع
যতদিন আল্লাহকে ডাকার মত কেউ থাকবে
أيها المبعوث فينا
ওহ, আমাদের পথ প্রর্দশক আজকে আমাদের মধ্যে
جئت بالأمر المطاع
যিনি (আল্লাহর পক্ষ থেকে )আদেশ/উপদেশ নিয়ে এসেছেন যার প্রতি আমাদের কর্ণপাত করতে হবে।
جئت شرفت المدينة
আপনি এই শহরের জন্য প্রশংসা/মর্যাদা বয়ে নিয়ে এসেছেন
مرحبا يا خير داع
স্বাগতম আপনাকে, যিনি আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন/সঠিক পথ সম্বন্ধে বলবেন
বদরের যুদ্ধে আবু বকর রা.
প্রতিটি যুদ্ধের ময়দানে রাসূলের সাথি ছিলেন হযরত আবু বকর রা.। তিনি খুব কাছ থেকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসূলের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
আল্লামা জামাখশারী রহ. বলেন, হযরত আবু বকর রা. সর্বদা নিজেকে রাসূলের জন্য কুরবান করেছেন। শৈশবে তারা ছিলেন খেলার সাথী।
কিশোর বয়সে একত্রে চলাফেরা করতেন। যৌবনে সর্বদা একে অপরের পাশে ছিলেন। ইসলাম আসার পর আবু বকর রা. ইসলামের জন্য অকাতরে খরচ করেছেন।
যুদ্ধের ময়দানে
মদীনায় হিজরতের পর সর্বপ্রথম যুদ্ধ ছিল বদরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই প্রথম কাফেরদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয়।
যেখানে মুসলমান সৈন্য ছিল মাত্র ৩১৩ জন। আর কাফেরদের সৈন্য ছিল ১০০০ জন।
রাসূল সা. তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন।
যদি আজ মুসলমানদের পরাজয় হয় তাহলে ইসলাম এখানেই ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। নবী কারীম সা. যুদ্ধের ময়দান বিন্যাস করলেন।
বদরের যুদ্ধে আবু বকর রা. ছিলেন নবীজির দেহরক্ষী।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেই কাফেরই নবীজির নিকটবর্তী হতো তাকেই শেষ করে দিতেন আবু বকর রা.।
বদর যুদ্ধের পর
বদর যুদ্ধে অনেক কাফের মুসলমানদের হাতে বন্দী হলো। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ এর অধিক।
এত এত বন্দীকে কি করা যায়, সেটা নিয়ে পরামর্শে বসলেন নবীজি।
হযরত আবু বকর রা. মতামত দিলেন, এই বন্দীরা তো আমাদের বংশের লোক। তাই তাদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে ছেড়ে দিলে হয়তো ভালো হবে।
এতে আমরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবো। আর তারাও হয়তো আল্লাহর ইচ্ছায় একসময় মুসলমান হয়ে যাবে।
হযরত ওমর রা. মতামত দিলেন, এই কাফেরদের গর্দান উড়িয়ে দিন। তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিন। কারণ, এরা কুফরের নেতা এবং তাদের পরামর্শদাতা।
আকিল বিন আবু তালেবকে আলী রা. এর নিকট এবং অমুককে আমার হাতে তুলে দিন। আমরা তাদের গর্দান উড়িয়ে দিব।
আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. মতামত দিলেন, এমন একটি উপত্যকার সন্ধান করুন, যেখানে অনেক খড়ি আছে। আর তাদেরকে সেখানে জ্বালিয়ে দিন।
কিন্তু রাসূল সা. আবু বকর রা. এর মতকে প্রাধান্য দিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে কাফেরদের মুক্ত করে দেন। কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ তা’আলা ওমর রা. এর মতের স্বপক্ষে কুরআনের আয়াত নাজিল করেন।
ওহুদ যুদ্ধে আবু বকর রা.
বদরের যুদ্ধের পর ওহুদ যুদ্ধ ছিল মুসলমান এবং মুশরিকদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। বদর যুদ্ধে কাফেররা শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পরে যখন তারা প্রতিশোধের স্পৃহায় আবার একত্রিত হলো, তখনই সংগঠিত হলো ওহুদ যুদ্ধ।
প্রতিশোধ ও ক্রোধ
বদর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার পর মক্কার কাফেররা ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা শপথ করলো, মুসলমানদের এক এক করে হত্যা করবে।
বদর যুদ্ধে কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার আর মুসলমানদের মাত্র তিনশত তেরো জন। এই যুদ্ধে আবু জাহল, উতবা, শায়বার মতো কট্টরপন্থি কাফেরদের সলীল সমাধি ঘটলো।
ওহুদের যুদ্ধের জন্য মক্কার কাফেররা পূর্বের থেকেও বড় প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই যুদ্ধে তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার। অর্থাৎ পূর্বের থেকেও আরো তিনগুণ।
কাফেরদের যুদ্ধের প্রস্তুতি
কাফেররা বদর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার পর মক্কায় গিয়েই শুরু করলো যুদ্ধের প্রস্তুতি। প্রায় পূর্ণ এক বছর তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
এই সময়ে তারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র, সৈন্য, খাদ্য ও নানাপ্রকার রণসামগ্রী সংগ্রহ করে তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে মদীনায় আক্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করে।
এই যুদ্ধে ৩০০০ হাজার সৈন্যের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে বহু কবি-সাহিত্যিক ও নারীরা। তাদের কাছ ছিল, নিস্তেজ হয়ে পড়া সৈন্যদের মনোবল জাগ্রত করা।
মুশরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অংশগ্রহণ
মুশরিকদের সেনাপ্রধান ছিল আবু সুফিয়ান। তার সাথে ছিল তার স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবা ইবনে রবিআ।
বদর যুদ্ধে নিহত আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা বিন আবু জাহলও অংশগ্রহণ করলো ওহুদ যুদ্ধে। সাথে ছিল তার স্ত্রী উম্মে হাকীম বিনতে হারিস।
আবু জাহলের ভাই হারিস বিন হিশাম ও ছিল এই ওহুদ যুদ্ধে। সাথে ছিল তার স্ত্রী ফাতেমা বিনতে ওলাীদ বিন মুগিরা।
মুসলমানদের প্রস্তুতি
রাসূল সা. যখন জানতে পারলেন মক্কায় তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তিনিও মুসলমানদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
রাসূল সা. একটি পরামর্শসভা ডাকলেন। সেখানে তিনি বললেন, যুদ্ধ কোথায় অবস্থান করে করলে ভালো হবে? তখন নবী সা. মতামত দিলেন যে, আমার মতে মদীনায় থেকেই আমরা যুদ্ধ করি।
এতে আমরা মদীনায় সকলে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবো। আমরা তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করে হলেও মোকাবেলা করতে পারবো।
কিন্তু তখন এমন অনেক মুসলমান ছিল, যারা বদর যদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। তাই তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা মদীনা থেকে বের হয়েই যুদ্ধ করি।
রাসূল সা. শেষ পর্যন্ত সাহাবাদের কথায় মদীনার বাহিরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু তিনি এতে সন্তুষ্টি ছিলেন না।
দিনটি ছিল শুক্রবার। নবীজি জুমআর নামাজ পড়ে যুদ্ধের পোশাক পরিধান করলেন। তারপর সকলকে যুদ্ধের জন্য বের হতে নির্দেশ দিলেন।
বিজ্ঞ সাহাবারা পরষ্পর বলাবলি করতে লাগলো, রাসূল তো মদীনায় থেকেই যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু আমরা বাধা সৃষ্টি করলাম। এখন কোন বিপদ হয়, আল্লাহই ভালো জানেন।
শেষে সাহাবারা বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি মদীনাতেই থাকুন। আমরা মদীনাতেই আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো।
রাসূল সা. বললেন, কোনো নবী যখন যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে ফেলে তখন সেখান থেকে ফিরে আসা শোভনীয় নয়।
আমি তো তোমাদেরকে আগেই বলেছিলাম, তোমরা রাজী হলে না। এখন তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং তাওবা করো।
ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যসংখ্যা
বদর যুদ্ধে মুসলমানরা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। ওহুদ যুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১০০০ জন। এই যুদ্ধে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও ছিল।
কিছুদূর গিয়ে সে তার ৩০০ অনুসারীকে নিয়ে পিছুটান নেয়। তারা দলত্যাগ করে চলে যায়।
শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা ছিল মাত্র ৭০০ জন। তাদেরকে নিয়েই রাসূল সা. ওহুদের ময়দানে পৌছেন।
যুদ্ধ
যুদ্ধের শুরুতেই আবু বকর রা. রাসূলের দেহরক্ষী হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। এই যুদ্ধে রাসূল সা. এর নির্দেশ অমান্য করার কারণে বড় একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।
তখন চারিদিকে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মুহাম্মাদ সা. নিহত হয়েছেন। সাহাবারা এটা শুনে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তারা যেন চোখে শর্ষেফুল দেখতে থাকে।
তখন আবু বকর রা. কাফেরদের বেষ্টনি অতিক্রম করে রাসূলের নিকট পৌছে যান।
এরপর আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা., আলী রা., যুবায়ের রা., তালহা রা., উমর রা., হারিসা ইবনে সাম্মাহ রা., প্রমুখ সাহাবারা রাসূলের নিকট এসে রাসূলকে কাফেরদের থেকে নিকট থেকে সরিয়ে ফেলেন।
এই সাহাবারা রাসূলের চারিপাশে বেষ্টনির ন্যায় অবস্থান করছিল। রাসূলের নিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তালহা রা.।
তিনি মুশরিকদের চারপাশ থেকে আক্রমণ করছেন। কখনো ডাকদিক থেকে বা কখনো বামদিক থেকে। আবু বকর রা. বলেন, আমি এই সুযোগটা সম্পূর্ণ হারিয়েছি। যদি তালহার জায়গায় আমি হতাম!
এরইমধ্যে জনৈক কাফেরের আঘাতে রাসূলের দাঁত ভেঙ্গে গেল। তার চেহারায় রক্ত লাল হয়ে গেছে।
মাথায় পরিধান করা শিরস্ত্রাণ ভেঙ্গে গালের ভেতর ঢুকে পড়েছিল।
রাসূল এই কঠিন পরিস্থিতিতেও বলছিলেন, তালহার কি খবর, তার খবর নাও।
আবু বকর রা. বলেন, তখন আমরা রাসূলের চেহারা ঢুকে যাওয়া লোহার টুকরো বের করতে উদ্যত হলাম।
তখন আবু উবায়দা রা. বললেন, আল্লাহর দোহাই, এই কাজটি আমাকে করতে দিন।
আবু উবায়দা রা. দাঁত দিয়ে কামড়ে লোহার একটা টুকরো বের করলেন। লোহাকে দাঁত নিয়ে বের করার কারণে তার একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।
দ্বিতীয় লোহাটি আমি বের করতে চাইলে এবারও আবু উবায়দা রা. আমাকে বাধা দিয়ে তিনি কাজটি করতে চাইলেন। ফলে আবু উবায়দা রা. এর দুইটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।
আবু সুফিয়ানের হুঙ্কার
যদ্ধের কঠিন সময়ে আবু সুফিয়ান চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, মুহাম্মাদ কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?
নবীজি তখন সাহাবাদেরকে উত্তর দিতে নিষেধ করলে। দ্বিতীয়বার আবু সুফিয়ান বললো, আবু বকর কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?
তৃতীয়বার আবু সুফিয়ান বললো, উমর কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে?
এরপর আবু সুফিয়ান বলতে লাগলো, মনে হয় তারা মারা গেছে।
তখন উমর রা. বললেন, হে আল্লাহর দুশমন! এরা সবাই এখনো জীবিত আছে।
হুদাইবিয়ার দিন আবু বকর রা.
রাসূল সা. একদিন স্বপ্ন দেখলেন, তিনি সাহাবাদেরকে নিয়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করছেন। এরপর তিনি কা’বাঘরের চাবি গ্রহণ করে সাহবাদেরকে নিয়ে ওমরাহ পালন করেন।
নবীদের স্বপ্ন হলো একরকম ওহীর ন্যায়। তাদের নিকট আল্লাহ ফেরেশতার মাধ্যমে ওহী পাঠান। আবার স্বপ্নেও তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়।
রাসূল সা. তখন সাহাবাদেরকে এই স্বপ্নের কথা জানালেন। সকলেই খুব খুশী হলেন এবং ওমরাহ পালন করার আগ্রহ পোষণ করলেন।
ওমরাহর জন্য সফর
রাসূল সা. তখন মক্কায় ওমরাহ করবেন বলে ঘোষণা করে দিলেন। অনেক সাহাবারাই ইতস্তত করছিলেন, কারণ মক্কা কাফেরদের দখলে।
ইতোমধ্যেই রাসূল সা. প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। মদীনার ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম রা. কে নিয়োগ দেয়া হলো।
এই ঘটনা সংগঠিত হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর ১ যিলকদ তারিখে। এই দিন তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন। এই সফরে রাসূলের সাথে ছিলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা.।
রাসূলের সাথে এই সফরে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০ জন। তবে ইবনে কাসীর রহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল বিদায়ায় উল্লেখ করেছেন, লোকসংখ্যা ছিল ৭০০ জন।
এই সফরে ভারী কোনো যুদ্ধাস্ত্র ছিল না মুসলমানদের সাথে। তাদের নিকট অন্যান্য মুসাফিরদের ন্যায় শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য কোমরে তরবারি ছিল।
যুল হোলায়ফায়
রাসূল সা. একজন ব্যক্তিকে আগেই পাঠিয়ে দেন পরিস্থিতি কেমন, তা জানার জন্য। যখন রাসূল যুল হোলায়ফায় আসলেন তখন তিনি কুরবানীর পশুকে সজ্জিত করলেন এবং উটে চিহ্ন দিয়ে দিলেন।
সে সময় উক্ত ব্যক্তির মাধ্যমে খবর আসলো, মক্কার মুশরিকরা আগেই রাসূলের আগমনের খবর জেনে গেছে। তারা এই ওয়াদায় সংকল্প করেছে যে, মুহাম্মাদ সা. কে মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না।
পাশাপাশি তারা মক্কার আশেপাশে সৈন্য জড়ো করে রেখেছে। রাসূল সা. এই খবর শুনে উপস্থিত ব্যক্তিদের বললেন, এখন কি করা যায়?
হযরত আবু বকর রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো কা’বা যিয়ারত করতে এসেছেন। কাউকে হত্যা বা যুদ্ধের জন্য নয়। তাই আপনি এগিয়ে চলুন। যদি তারা বাধা দেয়, তাহলে আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত আছি।
রাসূল সা. তখন বললেন, আল্লাহর নামে এগিয়ে চলো।
কুরাইশদের বাধা
এদিকে কুরাইশরা এই খবর শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, মুহাম্মাদ যেন মক্কায় প্রবেশ করতে না পারে। এরপর মক্কাবাসীরা নবীজির নিকট দূত পাঠায়।
রাসূল সা. আগেই এই ইচ্ছা পোষণ করেছেন, যদি তারা স্বাভাবিক কোনো দাবী উত্থাপন করে তাহলে মক্কাবাসীদের সাথে অটুট সম্পর্ক রক্ষায় মেনে নেয়া হবে।
তবে আল্লাহর বিরুদ্ধে যায় বা ইসলামের বিরুদ্ধে যায়, এমন আইন মানা হবে না।
সন্ধির আলোচনা
সর্বপ্রথম কুরাইশদের দূত হিসেবে আগমন করে বনু খুজআর সদস্য বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা। তিনি রাসূল কেন এসেছেন, জেনে ফিরে যান।
এরপর পর্যায়ক্রমে আরো কয়েকজন আসেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন উরওয়া ইবনে মাসউদ। উরওয়ার সাথে রাসূলের আলোচনা শুরু হয়।
উরওয়া তখন মুসলমানদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য বলে, হে মুহাম্মাদ! এই অভদ্র (রাসূলের সাহাবারা) লোকগুলো তো তোমার সর্বনাশ করে ছাড়বে।
মনে রেখ, কুরাইশদের সকলেই যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এবং যুদ্ধের জন্য উৎকৃষ্ট বাহন নিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা এই শপথ করেছে যে, তোমাকে কিছুতেই মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
আর তোমার সাথে থাকা এই গুটিকয়েক লোকেরা তো কুরাইশদের ভয়ে তোমাকে রেখে পালিয়ে যাবে। তুমি তখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে।
আবু বকর রা. উরওয়ার এই কথা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি। উরওয়াকে বললেন, তুমি গিয়ে তোমার প্রতিমার কাছে বসে থাক। আমরা কি রাসূলকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে পালিয়ে যাব?
জেনে রাখো, কখনো এমন হবে না কখনই না।
উরওয়া তখন বললো, এই লোকটি কে? নবী সা. বললেন, আবু বকর।
উরওয়া বললো, সে পূর্বে আমার উপর অনুগ্রহ করেছে। তাই তাকে কিছু বললাম না।
হুদাইবিয়ার সন্ধির ব্যাপারে আবু বকরের অবস্থান
হুদাইবিয়ার সন্ধি বাহ্যিকভাবে মনে হচ্ছিল, তা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই হযরত ওমর রা. অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
তিনি রাসূলের নিকট গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আল্লাহর নবী নন?
তিনি বললেন, অবশ্যই আমি আল্লাহর নবী ও রাসূল।
উমর রা. এরপর বললেন, আমরা কি মুসলমান নই? রাসূল সা. বললেন, অবশ্যই তোমরা মুসলিম। তখন ওমর রা. বললেন, তাহলে কেন আমরা দীনের ব্যাপারে হীনতা অবলম্বন করবো?
তখন আল্লাহর নবী বললেন, ওমর আমি আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিত কোনো কাজ করি না। তিনি আমাকে ধ্বংস করবেন না।
এরপর ওমর রা. আবু বকর রা. এর নিকট যান। তাকেও একইভাবে জিজ্ঞাসা করেন। মুহাম্মাদ সা. কি আল্লাহর রাসূল নন? আবু বকর রা. মূল বক্তব্য বুঝতে পেরে বললেন,
অভিযোগ না করে আনুগত্য করো। এতেই কল্যাণ রয়েছে। এরপর আবু বকর রা. বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয় মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তিনি আল্লাহর হুকুম মোতাবেকই কাজ করে থাকেন।
এভাবেই আবু বকর রা. হুদাইবিয়ার দিন রাসূলের পক্ষে অবস্থান করেন। পরবর্তীতে দেখা গেল, এই হুদাইবিয়াই ছিল সুস্পষ্ট বিজয়।
মক্কা বিজয়ের দিন আবু বকর রা.
হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মুসলমানরা কুরাইশদের সাথে দীর্ঘ একটা যুদ্ধবিরতি পেল। ফলে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়লো দূর বহুদূর।
এরইমাঝে রাসূলের সাহাবাদের সাথে মূতার যুদ্ধ ও খাইবারের যুদ্ধ সংগঠিত হলো। ছোট ছোট আরো বেশ কিছু গাযওয়া সংগঠিত হলো।
ঠিক এই সময় কুরাইশরা বড় একটি ভুল করে বসে। বনু বকর ইবনে ওয়াইল গোত্র বনু খুজাআর উপর আক্রমণ করে বসে। বনু খুজাআও তখন এই চুক্তির অন্তর্ভূক্ত ছিল।
এমনকি তারা এই হামলার মাঝেই ক্ষান্ত থাকে নি, কুরাইশদের বড় বড় নেতারা এই হামলার পেছনে মদদ জুগিয়েছে।
রাসূল সা. এর নিকট বনু খুজআর একজন মজলুম ব্যক্তি এসে এই সংবাদ জানালো। মুহাম্মাদ সা. বললেন, আমি অবশ্যই তোমাদের সাহায্য করবো ইনশাল্লাহ।
যেহেতু চুক্তি অনুযায়ী এটা গর্হিত একটি কাজ ছিল, তাই রাসূল সা. কুরাইশদের নিকট দূত প্রেরণ করলেন। কুরাইশদেরকে দূতের মাধ্যমে বললেন,
হয় তোমরা বনু খুজাআর রক্তপণ আদায় করো। কিংবা নিজেদের এর থেকে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা দাও। অথবা হুদাইবিয়ার সন্ধির সমাপ্ত ঘোষণা করো।
কুরাইশরা আত্মগর্বে জবাব দেয়, আমরা সন্ধি সমাপ্ত ঘোষণা করছি। নবীজির দূত তখন মদীনায় এসে এই কথা নবীকে জানায়।
আবু সুফিয়ানের মদীনা আগমন
নবীজির দূতকে ফেরৎ পাঠানোর পর তারা বুঝতে পারলো, কাজটি উচিৎ হয় নি। তাই মক্কার অন্যতম বড় নেতা আবু সুফিয়ানের মদীনায় আসলো।
সে নবীজিকে বললো, মুহাম্মাদ সন্ধিচুক্তির মেয়াদ আরো বাড়িয়ে নিন এবং তা আরো দৃঢ় করে নিন।
নবীজি তখন তীর্যক ভাষায় বললো, তুমি কি এ জন্যই মদীনায় এসেছ? তবে কি তোমরা কোনো চুক্তিভঙ্গ করেছ?
আবু সুফিয়ান বললো, আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। আমরা হুদাইবিয়ার সন্ধির উপর দৃঢ় আছি।
নবীজি তখন তাকে কোনোরূপ উত্তর প্রদান করেন নি। এরপর আবু সুফিয়ান আবু বকরের নিকট চলে যায়। তার নিকট সন্ধির মেয়াদ বৃদ্ধি এবং তা নবায়ন করার অনুরোধ করে।
কিন্তু আবু বকর রা. স্পষ্ট বলে দেন, আল্লাহর শপথ, আমি যদি পিপিলিকাকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখি তাহলে তাদেরকে আমি সহায়তা করবো।
নবীজির মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি
এই ঘটনার পর আবু বকর রা. তার মেয়ে আয়েশার ঘরে যান। মেয়েকে তিনি কোনো যুদ্ধ হবে নাকি এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন।
কিন্তু মেয়ে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন নবীজি ঘরে আসলেন। আবু বকর রা. তখন নবীজিকে বললেন,
হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন?
নবীজি বললেন, হ্যাঁ।
আবু বকর রা. বললেন, কার বিরুদ্ধে? রোমানদের বিরুদ্ধে?
নবীজি বললেন, না।
এরপর আবু বকর রা. বললেন, তাহলে কি নাজদবাসীর বিরুদ্ধে? নবীজি বললেন, না। এরপর আবু বকর রা. বললেন, তাহলে খুব সম্ভব আপনি কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?
নবীজি বললেন, হ্যাঁ। আবু বকর রা. তখন বললেন, সন্ধির মেয়াদ তো এখনো বাকী আছে। নবীজি তখন বললেন, তারা চুক্তিভঙ্গ করেছে। তুমি কি বনু খুজআর সঙ্গে কি ঘটেছে তা জানো না?
আবু বকর রা. তখন যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলেন।
মক্কা অভিযানের তারিখ
আল্লামা ইবনে ইসহাক র. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সা. ৮ম হিজরীর রমজান মাসের ১০ তারিখে মদীনা ত্যাগ করেন।
ইমাম বাইহাকী রহ. ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেন, রমজান মাসেই বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
ইমামা বুখারী রহ. ও ইউনুস রহ. ও ইবনে আব্বাস হতে রমজান মাসে সফরের কথা উল্লেখ করেছেন।
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে, মক্কা বিজয় সংগঠিত হয়েছে ৮ম হিজরীর রমজান মাসে। তবে এটা মাদানী বর্ষপঞ্জিকার রমজান মাস ছিল না।
কারণ, হিসাব অনুযায়ী তখন মাদানী বর্ষপঞ্জিকার তারিখ হলো, ৯ হিজরীর সফর মাস। তবে ঐতিহাসিকরা এই ঘটনাকে মক্কী বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী বর্ণনা করেছেন।
মক্কায় প্রবেশকালে আবু বকর রা.
যখন নবী সা. মক্কা বিজয়ের দিন সাহাবাদের নিয়ে মক্কার নিকটবর্তী হলেন তখন আবু বকরও রাসূলের পাশে ছিলেন।
নবীজি দেখতে পেলেন, নারীরা মুসলমানদের ঘোড়াগুলোর দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নবীজি তখন আবু বকরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
হাসসান (হযরত হাসসান বিন সাবেত রা.। একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন তিনি) কি যেন বলেছিল?
কবিতাটি তখন আবু বকর রা. আবৃতি করলেন,
যদি আমাদের অশ্বারোহীদের ধূলি উড়িয়ে কিদার দিকে যেতে না দেখ,
তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাও।
বর্শা চালাতে আমরা পুরোপুরিভাবে মোকাবেলা করছি,
তাদের কাঁধে রয়েছে তীর ও তরবারী।
আমাদের ঘোড়াগুলো দ্রুততায় পরষ্পরের প্রতিযোগী,
মহিলারা ওড়না দিয়ে ঘোড়ার ধূরের দূলি থেকে নিজের রক্ষা করে।
নবীজি তখন বললেন, হাসসান যেই দিকের কথা বলেছে, সেদিক দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করো। অর্থাৎ কিদা এলাকা নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করো।
মক্কা বিজয়ের দিন আবু বকর রা. এর পিতা আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাবুক যুদ্ধ ও আবু বকর রা.
৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম আরো দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এরইমধ্যে পুরো আরব অঞ্চল ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়।
যেই আরবে সামান্য থেকে সামান্য বিষয় নিয়ে যুগের পর যুগ যুদ্ধ চলতো, যেখানে মানবতার লেশমাত্রাও ছিল না,
তারা আজ এক পতাকাতলে সমবেত হয়েছে।
আরবের দুই পাশেই বিশাল দুই সাম্রাজ্যের অবস্থান। পারস্য সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য।
পশ্চিমে পারস্য সাম্রাজ্য ক্ষমতাদ্বন্দ্বে ভাঙ্গনের শিকার। কিন্তু বাইজেন্টাইন রোমানরা মুতাযুদ্ধের পরই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল।
তারা আরব সীমান্তবর্তী খৃষ্টানদের সাথে হাত মেলালো এক বড় যুদ্ধের জন্য।
প্রায় চল্লিশ হাজারের বাইজেন্টাইন বাহিনী বালকা নামক স্থানে এসে শিবির স্থাপন করে।
নবীজির নিকট সংবাদ
নবী সা. এই সংবাদ জানতে পারেন নাবতিদের মাধ্যমে। তারা শাম থেকে যাইতুন তৈল এসে হিজাজে বিক্রি করতো।
নাবতি বিন ইসলাইল হলো এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে তারা উত্তর হিজাজে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। পরে ক্ষমতা হারানোর পর ব্যবসা ও চাষাবাদে লিপ্ত হয় তারা।
নবীজি রোমান খৃষ্টানদের এই অগ্রযাত্রার কথা শুনে চিন্তিত হন। মদীনাবাসীরা পূর্ব থেকেই রোমানদের আক্রমণের আশঙ্কা করতো।
এই খবর শুনে তারাও বিচলিত হয়ে পড়ে।
রণাঙ্গনের প্রস্তুতি
যেহেতু এই যুদ্ধে রোমানরা আগে থেকেই অগ্রসর হচ্ছে, তাই তারা মদীনায় চলে মদীনাকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তা ছাড়া যদি খন্দকের যুদ্ধের ন্যায় পরিখা খনন করা হয়, তাহলে বাইজেন্টাইন খৃষ্টানরা শহর অবরোধ করে আরবদের থেকে মদীনাকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে।
তাই নবী সা. নিজেই মদীনা থেকে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন।
ফান্ড
নবীজি সা. সাহাবাদেরকে মসজিদে সমাবেত করে জিহাদের ফান্ডে দান-সাদকা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। মুজাহিদরা তখন বড় বড় অঙ্কের ফান্ড নিয়ে আসেন।
হযরত আসেম বিন আদি রা. ৯০ অসাক খেজুক দান করেন। হযরত উসমান রা. মালামালসহ ৩০০ উট এবং ১ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দান করেন।
আর হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. ১০০ উকিয়া সামানা নিয়ে আসেন। উমর রা. ঘরের অর্ধেক সম্পদ এনে রাসূলের সামনে পেশ করেন।
হযরত আবু বকর রা. ব্যবাসায়ী ছিলেন বিধায় তিনি যথেষ্ঠ সচ্ছল ছিলেন। তিনি ঘরের সমস্ত সম্পদ এনে রাসূলের সামনে পেশ করেন।
যুদ্ধে যাত্রা
৯ম হিজরীর ৩ রজব রোজ বৃহষ্পতিবার রাসূল সা. ৩০ হাজার সাহাবার বিশাল এক বাহিনী নিয়ে রোমানদের মোকাবেলার জন্য শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
যখন মুসলিম বাহিনী সানিয়াতুল বিদা উপত্যকায় আসেন তখন নবীজি পুরো বাহিনীকে পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন প্লাটুনে অধিনায়ক ও পতাকা নির্ধারণ করেন।
তখন সবচেয়ে বড় এবং মর্যাদা সম্পূর্ণ পতাকাটি ছিল আবু বকর রা. এর হাতে।
তাবুকে অবস্থান ও বিজয়
নবীজি শামের সীমান্তে তাবুক নামক ঝর্ণার কাছে সেনা ছাউনি স্থাপন করেন। যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। কিন্তু রোমান খৃষ্টানরা ভয়ে সামনে অগ্রসর হলো না।
তারা যখন জানতে পারলো,
মুসলমানরা ৩০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়েছে তখন তারা মদীনা আক্রমণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে শহরের দিকে পলায়ন করলো।
রাসূল সা. তাবুক নামক স্থানে ২০ দিন অবস্থান করলেন। মদীনা থেকে তাবুকে আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রায় এক মাস সময় ব্যয় হয়েছে।
নবীজির জীবদ্দশায় এই তাবুক যুদ্ধ ই ছিল তার শেষ স্বশরীরে জিহাদে যাত্রা।
আবু বকর রা. এর খেলাফতে আরোহণ
নবীজির মৃত্যুর আগে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। উনার জ্বরের তীব্রতা খুব বেড়ে যায়। ফলে তিন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরইমধ্যে ইশার নামাজের সময় হয়ে যায়।
তাই চেতনা ফিরে আসতেই তিনি উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞাসা করেন, নামাজ কি পড়ে ফেলেছ? তারা বলেন, না ইয়া রাসূলাল্লাহ।
আয়েশা রা. তখন তাকে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! লোকেরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তখন রাসূল সা. মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু দুর্বলতার কারণে সম্ভব হলো না।
এরপর আবার বেঁহুশ হয়ে পড়লেন। এভাবে তিনবার বেহুশ হয়ে পড়ার পর নবীজি বললেন, “আবু বকরকে বলো, তিনি যেন নামাজ পড়ায়।”
হযরত আয়েশা রা. আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আব্বাজান খুবই নরম দিলের মানুষ। তিনি আপনার জায়গায় ইমামতি করার ভার সইতে পারবেন না।
তখন নবীজি এই কথা উপেক্ষা করে শক্ত ভাষায় বললেন, “আবু বকরকেই আদেশ করো, যাতে তিনি নামাজের ইমামতি করেন।”
এটাই ছিল রাসূলের পরে উম্মতের প্রতিনিধি ও নায়েব বানানোর সুক্ষ্ম ইঙ্গিত। যদিও তখন মুসলমানরা ঈমান-আখলাক, ভ্রাতৃত্ববন্ধন, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনায় রাসূলের প্রতিনিধি ছিলেন,
তারপরও তিনি উম্মাহর মধ্য থেকে একজনকে নায়েব করে যাওয়ার ব্যাপারে সুক্ষ্ম ইঙ্গিত প্রদান করেছিলেন।
হযরত আবু বকর রা. রাসূলের অসুস্থতার দুশ্চিন্তায় এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, তাই তিনি তৎক্ষণাৎ রাসূলের হুকুম পালন করতে পারেন নি।
তাই হযরত উমর রা. আগ বেড়ে নামাজ পড়ানোর জন্য দাঁড়ালেন। রাসূল সা. যখন উমরের কণ্ঠ শুনলেন তখন তিনি জোরে আওয়াজ দিয়ে বললেন, “না, না, না। আবু বকরই নামাজ পড়াবে।”
এরপর তিনি বললেন, “আবু বকরকে ছাড়া কাউকে ইমাম আল্লাহ তায়ালাও বানাতে দিবেন না এবং অন্য মুসলমানরাও বানাবে না।”
কেন রাসূল আবু বকরের নাম প্রকাশ করেন নি
যদিও রাসূল সা. তার নায়েবের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে নাম উল্লেখ করা অনুচিত মনে করতেন। তাই তিনি তা মুসলমানদের শূরা (কমিটি) এর পরামর্শে ছেড়ে দেয়াটাই পছন্দ করতেন।
কিন্তু একদিন হঠাৎ মনে করলেন, এ বিষয়ে যেন মুসলমানরা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত না হয়।
তাই তিনি বললেন, আবু বকর ও তার ছেলেকে ডেকে আনো। আমি কিছু লিখে দিই। এমন যেন না হয়, আবু বকরের উপস্থিতিতে কোনো ক্ষমতালোভী এসে মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
নবীজির মৃত্যুর পর আবু বকর রা. এর ভাষণ
নবীজির মৃত্যুর পর সাহাবারা বিশ্বাস করতে পারেন নি, তাই অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন।
হযরত উসমান রা. এর অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল, তিনি শ্রবণশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছেন।
হযরত আলী রা. এক কোণে নির্বাক ও নিঃশব্দে বসে রইলেন। আর উমর রা. যেন নিজের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন।
তিনি উম্মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন, যে বলবে রাসূল ইন্তিকাল করেছে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিব।
হযরত আবু বকর রা. এই সময়ে মহৎ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
তিনি নবীজির মৃত্যুর খবর পেয়ে মদীনায় ছুটে আসলেন। সে সময় তিনি মদীনার পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে ছিলেন।
নবীজির হুজরায় প্রবেশ করে দেখেন, নবীজিকে চাদরবৃত করে রাখা হয়েছে।
তিনি তখন চাদর উঁচিয়ে কপাল মোবারকে চুমু খেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার উপর উৎসর্গ হোক। আপনার জীবনও ছিল উত্তম এবং আপনার ওফাত ও উত্তম।
এরপর আবু বকর রা. মসজিদে গমন করলেন। সেখানে উমর রা. পাগলের ন্যায় আচরণ করছিল। উপস্থিত সাহাবারা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল।
আবু বকর রা. ওমর রা. কে চুপ করালেন। এরপর সাহাবাদের সম্বোধন করে বললেন,
“বন্ধুগণ! যারা মুহাম্মাদ সা. এর ইবাদত করতে তারা জেনে রাখ, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে তারা জেনে রাখ, আল্লাহ জীবিত আছেন এবং চিরকাল থাকবেন।
কুরআন থেকে দলীল
এরপর তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াত তেলওয়াত করে বলেন,
وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ ۚ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِهِ الرُّسُلُ ؕ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡهِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰهَ شَیۡئًا ؕ وَ سَیَجۡزِی اللّٰهُ الشّٰکِرِیۡنَ
“আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসূল। তার পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসূল বিগত হয়েছে। যদি সে মারা যায় অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে ? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।”
এই আয়াতটি ওহুদযুদ্ধের সময় নবীজির মৃত্যুর খবরের গুজব রটে যাওয়ার পর নাযিল হয়েছিল।
আজ আবার তার মৃত্যুতে এই আয়াত শুনে বুঝতে পারলেন, আজই হলো এই আয়াত তেলওয়াতের উপযুক্ত সময়।
হযরত উমর রা. আবু বকর রা. এর ভাষণ শুনে নিজেকে শান্ত করলেন। তখন তার বিশ্বাস হলো নবীজি মারা গেছেন।
তাই তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জমিনে পড়ে গেলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, আল্লাহর কসম! আবূ বকর রাঃ এর পাঠ করার পূর্বে লোকেরা যেন জানত না যে, আল্লাহ তা‘আলা এরূপ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।
এরপর সমস্ত সাহাবী তাঁর থেকে উক্ত আয়াত শিখে নিলেন। তখন সবাইকে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম।
সা‘ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব রহ. জানিয়েছেন,
‘উমর রাঃ বলেছেন, আল্লাহর কসম! আমি যখন আবূ বকর রাঃ কে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম,
তখন ভীত হয়ে পড়লাম এবং আমার পা দু’টি যেন আমার ভার নিতে পারছিল না।
এমনকি আমি মাটিতে পড়ে গেলাম যখন শুনতে পেলাম যে, তিনি তিলাওয়াত করছেন যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেছেন।
মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্ন
রাসূলের মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহ গভীর শোকে কাতর। প্রত্যেকেই তখন চিন্তামনগ্ন যে রাসূলের পরে এখন মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব কে হাতে তুলে নিবে? কে হবে এখন মুসলিম উম্মাহর রাহবার?
কে হবে এখন মুসলিম উম্মাহর পথপদর্শক? দ্বীন এবং শরীয়তের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ এখন কাকে অনুসরণ করবে?
সে সময় আনসারী সাহাবারা সাকিফায়ে বনু সায়িদায় একত্রিত হলো। এটা ছিল সা’দ ইবনে উবাদা রা. এর বৈঠকখানা।
বনু সাকিফার বৈঠকখানায় সাহাবাদের নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা
দিনটি ছিল সোমবার। সময় আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বা মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত। মদীনায় সে সময় মুসলমানদের দুইটি ভাগ ছিল।
একভাগ ছিল মুহাজির। যারা নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেছে।
অন্য দল ছিল আনসার। যারা ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে মুহাজিরদের নিজেদের ভাই হিসেবে গ্রহন করেছে। মদীনায় অবস্থিত আনসারদের মধ্যে দুইটি বিখ্যাত বড় গোত্র ছিল।
বড় দুই গোত্র
একটা হলো আওস ও অন্যটা হলো খাযরাজ।
এরমধ্যে আবার আওস গোত্রের জনসংখ্যা ছিল কম এবং খাযরাজ গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বেশি। তৎকালীন আররে নেতৃত্ব বা অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে আধিক্যতাকেই প্রাধান্য দেয়া হতো।
তাই আনসারী সাহাবারা খাযরাজ গোত্রের সরদার সা’দ বিন উবাদা রা. এর ঘরের চত্বরে একত্রিত হলো।
তারা সেখানে বসে মুসলমানদের ভবিষ্যত নেতা ও অনুকরণীয় ব্যক্তি কে হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। এই আলোচনাসভাটি ছিল উম্মুক্ত আলোচনাসভা।
কেউ কেউ বলতে থাকে, ‘এখন খাযরাজ গোত্রের সরদার সা’দ বিন উবাদা রা. এর আমির হওয়া উচিৎ।’
তখন জনৈক সাহাবী বললেন, যদি মুহাজির ভাইয়েরা আমাদের সাথে মতানৈক্য করে তাহলে আমরা তাদের এই প্রস্তাব দিব,
আমির দুইজন হবে। একজন আনসারদের মধ্যে অন্যজন মুহাজিরদের মধ্যে।
সা’দ বিন উবাদা রা. এর মন্তব্য
এটা শুনে সা’দ বিন উবাদা রা. বললেন, “এখান থেকেই মুসলমানদের মধ্যে ফাঁটল সৃষ্টি হবে।”
তখন আনসারদের এই আলোচনাসভার কথা হযরত আবু বকর রা. এর কানে গেল।
তিনি সে সময় মসজিদে ননবীতে বসে ছিলেন। তিনি তখন উমর রা. ও আবু উবাইদা রা. কে নিয়ে উক্ত আলোচনাসভায় উপস্থিত হলেন।
তিনি তখন দেখতে পেলেন, সেখানে জাহেলী যামানার মতো এক সাহাবী নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বিবৃতি দিচ্ছে।
আবু বকর রা. তাকে এরূপ করতে নিষেধ করলেন। তখন তিনি সেখানকার উপস্থিত ব্যক্তিদের মতামত শুনছিলেন।
এরপর তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে ইসলামের সূচনাকাল থেকে নিয়ে তখন পর্যন্ত দ্বীনের জন্য সকলের ত্যাগ তিতিক্ষা বর্ণনা করলেন।
সে সময় তিনি রাসূলের বর্ণিত ছোট ছোট হাদীসগুলোও তিনি বর্ণনা করেন।
তিনি তখন উপস্থিত জনতাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে,
এ সময়ে কুরাইশদের হাতেই নৃত্বত্ব অর্পন করার মাঝে কল্যান নিহিত আছে। কারণ রাসূল সা. সা’দ বিন উবাদা রা. এর উপস্থিতিতেই বলেছিলেন,
“নেতৃত্বের দায়িত্ববান হলো কুরাইশরা। ভালো লোকেরা তাদের ভালো লোকদের পেছনেই চলতে পছন্দ করে। আর মন্দরা মন্দদেরকেই অনুসরণ করে।”
তখন সা’দ বিন উবাদা রা. বলেন, আপনি সঠিক বলেছেন। আমরা পরামর্শদাতা হবো আর আপনারা শাসক হবেন।
বশির বিন সা’দ রা. এর ভাষণ
সে সময় আনসারদের মধ্য হতে হযরত বশির বিন সাদ রা. বললেন,
হে আনসার সম্প্রদায়! নিঃসন্দেহে আমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি।
যার পেছনে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও রাসূলের আনুগত্য প্রদর্শন।
তাই এটা আমাদের জন্য মোটেও শোভনীয় হবে না যে, আমরা তুচ্ছ পদ-পদবী নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করবো। নিঃসন্দেহে রাসূল কুরাইশ বংশের ছিলেন। তাই তার নায়েব বা প্রতিনিধি ও তার বংশ থেকে হওয়া উত্তম।
এতে খলিফা নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। তখন উক্ত মসলিসে এটা চূড়ান্ত হয় যে, খলিফা একজনই হবেন এবং সেটা কুরাইশদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হবে।
তাই আবু বকর রা. উপস্থিত ব্যক্তিদের বললেন, তাহলে এর পরবর্তী বিষয়টারও সমাধান হয়ে যাক। তাই তিনি বললেন, তোমরা উমর অথবা আবু উবায়দার হাতে বাইয়াত হয়ে যাও।
ওমর রা. এর খলিফা হতে অস্বীকৃতি
আবু বকর রা. ওমর ও আবু উবাইদা রা. এর নাম এ জন্য উল্লেখ করেছেন যে, উক্ত মসলিসে আবু বকর ব্যতিত এই দুজনই শ্রেষ্ঠ সাহাবী ছিলেন।
একদিক থেকে তারা কুরাইশ বংশের। অন্যদিক থেকে তারা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী।
হযরত ওমর রা. তখন উপস্থিত লোকদের বললেন, তোমরা তো ভালো করেই জানো, রাসূল সা. ইন্তিকালের পূর্বে আবু বকরকে নামাজের ইমাম বানিয়েছিলেন। আর তিনি নবীজির সবচেয়ে কাছের সাহাবী।
তার মর্যাদাও আমাদের থেকে উঁচু। তাই এমন কে আছে যে আবু বকরের বর্তমানে তার চাইতেও বড় হতে চায়?
উপস্থিত সাহাবারা তখন বললেন, আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।
বাইয়াত গ্রহণ
উমর রা. আবু বকর রা. কে সম্বোধন করে বললেন, আমরা সকলে আপনার নিকট বাইয়াত হবো।
কারণ, আপনি আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সম্মানিত ও সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং আপনি রাসূল সা. এর প্রিয় বন্ধু।
তিনি আবু বকর রা. বাইয়াত নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তখন হযরত বশির বিন সাদ রা. সর্বাগ্রে আবু বকর রা. এর হাতে বাইয়াত হয়ে নিলেন।
এরপর উপস্থিত সাহাবারাও আবু বকর রা. এর বাইয়াত গ্রহন করলো।
বাইয়াতের সময় আলী ও যুবাইর রা. এর বিলম্বের কারণ
আবু বকর রা. সর্বসম্মতিক্রমে খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর এক এক করে সকলেই তার হাতে বাইয়াত গ্রহন করলো। কিন্তু তখন পর্যন্ত আলী রা. ও যুবাইর রা. উক্ত মজলিসে অনুপস্থিত ছিলেন।
কারণ, তারা রাসূলের কাফন-দাফনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে এদিকে কি হচ্ছে, তা জানতে পারেন নি।
কিন্তু সে সময় মুনাফিকরা গুজব ছড়াতে থাকে যে, আলী রা. ও যুবাইর রা. আবু বকর রা. কে খলিফা হিসেবে মেনে নেন নি। তাই আবু বকর রা. তাদের দুইজনকে সকলের সামনেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কি মুসলমানদের ঐক্যে কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চান?’
তারা তখন বললো, এমন কোনো কথা নয় হে খলিফায়ে রাসূল। এ কথা বলে তারা উভয়েও আবু বকর এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন। এরপর উভয়ই বললেন, আমাদের একটু আপত্তি ছিল যে,
আামির নির্বাচনের পরামর্শসভায় আমাদের উপস্থিত রাখা হয় নি। যদিও আমরা জানি, আপনি রাসূলের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি।
রোমানদের বিরুদ্ধে উসামা রা. এর বাহিনী প্রেরণ
রাসূল সা. জীবনের শেষদিনগুলোতে রোমানদের টুটি টেপে ধরার জন্য একটা বাহিনী তৈরী করেন। যারা জিহাদে যেতে কার্পণ্য করে না।
এই বাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন মুতার যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং শহীদ যায়েদ বিন হারিসা রা. এর সন্তান উসামা বিন যায়েদ রা.।
এই রোমানরা মুসলমানদের জন্য অনেক বড় হুমকি ছিল। তারা বারবার মুসলমানদের এবং আরব সীমান্তে আক্রমণের চেষ্টা করতো।
সর্বপ্রথম তাদের সাথে মুতার প্রান্তরে মুসলমানদের সাথে লড়াই হয়। পরবর্তীতে তাবুক যুদ্ধ হয়। এরপর ছিল এই উসামার বাহিনী।
উসামার নেতৃত্ব ও সাহাবাদের ভিন্ন মতামত
সে সময় উসামা রা. এর বয়স ১৯ পার হয় নি। তাই অনেক সাহাবারা নবীজিকে বলেছিলেন আমির বা সেনাপ্রধান পরিবর্তন করে দিতে।
তখন নবীজি তাদেরকে বললেন, আজ যদি তোমরা তার নেতৃত্বের উপর আপত্তি উত্থাপন কর (এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, কেননা) এর পূর্বে তোমরা তার পিতার নেতৃত্বের ওপরেও আপত্তি তুলেছিলে।
আল্লাহর শপথ! তার পিতা ছিল এ নেতৃত্বের যোগ্যতম ব্যক্তি এবং সে ও আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।”
নবীজি ইন্তিকালের দুইদিন আগে খুব জোর দিয়ে বলেছেন, তোমরা উসামার বাহিনীকে প্রেরণ করে দাও।
নবীজি উসামা রা. কে বলেছিলেন, তোমার পিতার শাহাদাতস্থলের দিকে বেরিয়ে পড়ো। আর আমি তোমাকে এই বাহিনীর সেনাপ্রধান নিযুক্ত করলাম।
হযরত আবু বকর রা. খেলাফতের আসনে আরোহণের পর সর্বপ্রথম তিনি গুরুত্বারোপ করে উসামার বাহিনীকে প্রেরণ করার। কারণ নবীজি তাড়াতাড়ি এই বাহিনীকে পাঠাতে বলেছিলেন।
ঠিক এমন সময় আরবের বিভিন্ন দিকে বিদ্রোহ এবং মুরতাদ হওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। তখন অন্যান্য সাহাবারা আবু বকরের নিকট বললো,
আপনি উসামার বাহিনীকে পরে প্রেরণ করুন। আগে এই বাহিনীকে মুরতাদদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করুন। আবু বকর রা. তা করতে অস্বীকার করলেন।
এরপর তিনি বললেন, যদি আমার প্রবল ধারণা হয়, হিংস্র জন্তুরা মদীনায় প্রবেশ করবে এবং আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে তবুও আমি এই বাহিনীকে প্রেরণ করবো।
আমি কিভাবে এই বাহিনী পাঠানো থেকে বিরত থাকতে পারি, যেখানে রাসূল সা. আদেশ দিয়েছেন।
চূড়ান্তভাবে উসামার বাহিনীকে প্রেরণ
হযরত আবু বকর রা. উসামার বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধির জন্য তাদের সাথে চলতে থাকেন। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. খলিফার বাহন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
উসামা রা. তখন ঘোড়ার উপর বসে ছিলেন। তিনি তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূলের খলিফা! আমি সওয়ারিতে আরোহণ করুন। অন্যথায় আমরা পায়ে হেঁটে চলবো।
আবু বকর রা. তখন জবাবে বললেন, তোমারও ঘোড়া থেকে নামা দরকার নেই। আমারও ঘোড়া থেকে উঠা দরকার নেই।
এতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি আমার পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলোমলিন করতে চাই।
ওমর রা. কে মদীনায় রাখা
উক্ত বাহিনীকে অন্যন্য মুজাহিদদের মতো হযরত উমর রা. ও ছিলেন। হযরত আবু বকর রা. তখন উসামাকে বললেন,
তুমি যদি চাও তাহলে ওমরকে আমার নিকট রেখে যেতে পার। তাকে আমার প্রয়োজন হতে পারে।
উসামা রা. তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিয়ে দেন। এই ঘটনা দ্বারা আমিরের মর্যাদা ও মতামতের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
আবু বকর রা. তখন ছিলেন মুসলিম বিশ্বের খলিফা। তার আদেশ মানতে সকলে বাধ্য।
তিনি চাইলে ওমর রা. কে নিজের নিকট রাখতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সেনাপ্রধানের নিকট তিনি অনুমতি চাইলেন।
উসামার বাহিনী চলে যাওয়ার পর মদীনার প্রতিরক্ষা
হযরত উসামা রা. তার বাহিনী নিয়ে মদীনা ত্যাগ করার পর মদীনার সামরিক শক্তি কমে যায়।
এ কারণে মুরতাদরা মদীনার আশেপাশে একত্রিত হতে থাকে।
মদীনার উত্তর দিক থেকে আবস ও জুবইয়ান গোত্র, উত্তর-পূর্বদিক থেকে বনু ফাযারা গোত্র, দক্ষিণ-পূর্ব থেকে বনু গাতফানের মুরতাদরা মদীনার দিকে ধেয়ে আসে।
আবু বকর রা. তখন প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি শহরের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেন এবং মদীনাবাসীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।
মুরতাদের আতঙ্ক
উসামা রা. এর বাহিনী শামের সীমান্ত দিয়ে অতিক্রম করছিল। এখানে একটা গোত্র মুরতাদ হওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিল।
তারা যখন এত বড় মুসলিম বাহিনী দেখে তখন ভড়কে যায়।
তারা বিদ্রোহের চিন্তা পরিত্যাগ করে।
কুজাআ অঞ্চল জয়
এই অঞ্চলে আসার পর উসামা রা. অশ্বারোহীদের ছড়িয়ে দেন। নবী সা. এই নির্দেশ করেছিলেন। আল্লাহর রহমতে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। এই অভিযানে ৪০ দিন অতিবাহিত হয়।
রোম সম্রাটের পলায়ন
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস নবীজির মৃত্যু সংবাদ এবং উসামার বাহিনীর ধেয়ে আসার খবর একসাথে পায়। এ কথা শুনে সে বিস্ময়ের সাথে বলতে থাকে,
এরা কেমন মানুষ? একদিকে তাদের প্রধান ইন্তিকাল করেছে অন্যদিকে তারা আমাদের উপর চড়াও হতে আসছে? এরপর হিরাক্লিয়াস আক্রমণের উদ্দেশ্যে পরিত্যাগ করে শহরেরে দিকে পলায়ন করে।
মদীনার পার্শ্ববর্তী মুরতাদদের পলায়ন
হিরাক্লিয়াস পালিয়ে যাওয়ার পর উসামা রা. বাহিনী নিয়ে মদীনায় যাত্রা করেন।
উসামার বিজয়ের সংবাদ শুনে মদীনার আশেপাশে থাকা মুরতাদরা মদীনা আক্রমণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে ভেগে গেল।
আবু বকর রা. এর যুগে ফেতনার আত্মপ্রকাশ
খলিফা আবু বকর রা. খেলাফতের মসনদে আরোহনের পর পরই তাকে তিনটা ফেতনার মোকাবেলা করতে হয়। যেই ফেতনাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছিল।
প্রথম ফেতনা ছিল, মিথ্যা নবুওতের দাবী করা।
দ্বিতীয ফেতনা ছিল, ইরতিদাদ বা মুরতাদ হয়ে যাওয়া।
তৃতীয় ফেতনা ছিল, জাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জানানো।
আবু বকর রা. উক্ত ফিতনাগুলোর সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। তিনি রাসূলের আদর্শ সামনে রেখে কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতাকে গুরুত্ব দেন নি।
মিথ্যা নবুয়ত দাবীদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ
আবু বকর রা. মদীনা থেকে ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত যিলকাসসা নামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। মুজাহিদ বাহিনীকে এগারভাগে বিভক্ত করেন।
প্রত্যেক ভাগে অভিজ্ঞ সাহাবীদেরকে আমির নির্ধারণ করেন। এরপর তিনি যুদ্ধের নকশা তৈরি করেন। সে নকশা অনুযায়ী তিনি এই এগারোটি বাহিনীকে আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে দেন।
এর দ্বারা মিথ্যা নবুওয়তের দাবিদার এবং তাদের অনুসারীদের দমন করাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
জাকাত আদায়ে অস্বীকারকারীদের সঙ্গে জিহাদ
নবীজির ইন্তিকালের পর একদল লোক নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকার পরও জাকাত আদায় করতে অস্বীকার করে।
এমনকি তারা খেলাফতের মূল স্তম্ভ মদীনায় প্রতিনিধিদল ও পাঠায়।
তারা এই দাবী পেশ করে যে, তাওহীদ রিসালাতসহ ইসলামের অন্যান্য সকল বিধি-বিধান তারা মান্য করবে। কিন্তু জাকাত আদায় করতে পারবে না।
যেন তাদের জিম্মা থেকে জাকাত মাফ করে দেয়া হয়।
কিছু কিছু সাহাবী এমনকি হযরত ওমর রা. ও এই নাজুক পরিস্থিতিতে খলিফা আবু বকর রা. কে তাদের আবদার মেনে নেয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু আবু বকর রা. তাদের এই আবদার মানলেন না। তিনি এই লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
হযরত ওমর রা. আবু বকর রা. কে বললেন, যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পড়ে তাদের বিরুদ্ধে কি আপনি যু্দ্ধ করতে চাচ্ছেন?
আবু বকর রা. এসব কথাকে উপেক্ষা করে ইসলামকে মূল রূপে রাখতে প্রত্যয়ী হন। এ কারণে তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ!
যে ব্যক্তি জাকাতকে নামাজের মতো গুরুত্ব না দিবে, আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।
রাসূলের যামানায় যে ব্যক্তি জাকাতের জন্য একটা বকরির বাচ্চা প্রদান করতো,
এখন যদি সে তা প্রদান না করে তাহলে আমি তার বিরুদ্ধে তরবারি হাতে নিব।
অনেকেই এটা ভেবে ভুল করে থাকেন যে, কি দরকার ছিল আবু বকরের এই যুদ্ধ ঘোষণা করার। অথচ নবীজি বলেছেন,
আমি মানুষের জন্য লড়াই করতে আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা বলে যে, আল্লাহ ব্যতিত কোনো ইলাহ নেই এবং তারা নামাজ কায়েম করে ও জাকাত প্রদান করে।
(সহিহ মুসলিম। হাদীস নং ১৩৮)
মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ
নবীজির ইন্তিকালের পর অনেক ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়। তারা ভেবেছে, মুহাম্মাদ যেহেতু মৃত্যুবরণ করেছে, তাই ইসলামও শেষ হয়ে গেছে।
তাদের বিরুদ্ধে আবু বকর রা. যুদ্ধ শুরু করেন। সাহাবাদের বড় বড় দলকে তাদের নিকট পাঠিয়ে দেন। এদের মধ্য থেকে কেউ ইসলাম গ্রহণ করে ফিরে আসে।
কেউ বা ইসলামকে অস্বীকার কবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তরবারি উঠিয়ে নেয়। তবে তারা বেশিদিন টিকতে পারে নি।
সাহাবারা এই ফেতনা থামিয়ে দিতে সক্ষম হন।
মুরতাদদের বিরুদ্ধে আবু বকরের অবস্থান
আবু বকর রা. মুরতাদদের খবর শুনে তাদেরকে দমন করার জন্য বাহিনী প্রস্তুত করলেন।
এই মুরতাদদের মধ্যে আরেকটি দল ছিল, যারা ইসলামের কিছু কিছু বিধানকে অস্বীকার করতো।
একটা দল ছিল, তারা যাকাত আদায় করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আবু বকর রা. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দল তৈরি করলেন।
তখন ওমর রা. এবং আলী রা. সহ আরো কয়েকজন সাহাবী বললো, তাদের সাথে পরে লড়াইয়ে লিপ্ত হোন। এখন তাদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দিন।
আবু বকর রা. তাদের এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ!
যদি কেউ জাকাতকে নামাজের মতো গুরুত্ব না দেয়, তাহলে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো।
মদীনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মুরতাদরা মদীনার আশেপাশে একত্রিত হতে থাকে। তাদের ইচছা, তারা মদীনা দখল করে সেখানে রাজত্ব কায়েম করবে।
এদিকে হযরত উসামা বিন যায়েদ রা. কে রাসূলের নির্দেশে আবু বকর রা. রোমানদের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ফলে মদীনায় পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই কম। এত কম ব্যক্তির উপর যদি হামলা করা হয় তাহলে নির্ঘাত মদীনার পতন হবে।
আবু বকর রা. তখন মদীনাবাসীরা রাতে মসজিদে অবস্থানের নির্দেশ দেন, যাতে প্রতিরোধ করার জন্য দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়।
মদীনার বিভিন্ন পথে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী তিনি মোতায়েন করেন। তাদের দায়িত্ব ছিল, তারা রাত্রীযাপন সেখানেই করবে। কোনো আক্রমণ হলে সেখানেই প্রতিরক্ষা গড়ে তুলবে।
প্রতিটি নিরাপত্তা দলে একজন করে আমির নির্দিষ্ট করে দেন। আমিররা ছিলেন, আলী, তালহা বিন উবায়দুল্লাহ,
যুবায়ের ইবনে আওয়াম, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, আবদুর রহমান ইবনে আউফ এবং আব্দু্ল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখ।
আবু বকর রা. মদীনার আশেপাশে থাকা গোত্রগুলোকে জিহাদের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। তারাও সন্তুষ্টিচিত্তে জিহাদে অংশগ্রহণ করে।
আবু বকর রা. মদীনা থেকে দুরবর্তী এলাকাগুলোর গভর্নরদের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। যাতে তারা তাদের এলাকায় মুরতাদদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
মদীনায় মুরতাদদের হামলা
মুরতাদরা মদীনায় একটা প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। তারা হযরত আবু বকর রা. এর নিকট আবেদন করে, যেন তাদের যাকাত মওকুফ করে দেয়া হয়।
আবু বকর রা. সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। ফলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে মদীনা ত্যাগ করলো।
আবু বকর রা. উপস্থিত ব্যক্তিদর বললেন, এরা অচিরেই মদীনায় হামলা করবে।
এই প্রতিনিধিদল মদীনা ত্যাগ করার পর পরই একরাতে আচমকা বনু আসাদ, গাতফান, আবস, জুবইয়ান ও বকর গোত্রের লোকজন মদীনায় হামলা করে।
তারা কয়েকজন মুসলমানকে বন্দী করে যুহাসা নামক স্থানে আটক করে রাখে।
মদীনার প্রহরীরা এটা জানার পর তারা আবু বকরকে অবহিত করেন।
আবু বকর রা. তখন মসজিদে অবস্থিত মুজাহিদদের নিয়ে মুরতাদদের উদ্দেশ্যে বের হলেন। তারা তখন মুসলমানদের উটগুলোকে বিভ্রান্ত করার জন্য পদ্ধতি অবলম্বন করে।
ফলে উটগুলো এদিক ওদিক ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। আরোহীরা উটগুলোকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না।
আবু বকর রা. তখন আর যুদ্ধ না বাড়িয়ে মদীনায় চলে আসলেন। শত্রুরা ভাবলো, আবু বকর ভয় পেয়েছে। তারা এটা নিয়ে কবিতা রচনা করলো।
মুরতাদদের বিরুদ্ধে ঝটিকা আক্রমণ
প্রায় ৪০ দিন পর হযরত উসামা রা. তার বাহিনী নিয়ে মদীনায় আসেন।
আবু বকর রা. তখন উসামাকে মদীনার স্থলাভিষিক্ত করে মুজাহিদদের নিয়ে রওয়ানা হন মুরতাদদের বিরুদ্ধে।
সাহাবারা তখন আবু বকর রা. কে অনুরোধ করেন মদীনায় থাকতে। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন।
একদিন ভোরের আলো ফোঁটার পূর্বেই আবু বকর রা. নিজের বাহিনী নিয়ে মদীনার পার্শ্ববর্তী মুরতাদদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন।
মুরতাদরা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি এই বাহিনীর আগমণের কথা। সূর্য উদয় হতে হতেই মুজাহিদরা বিজয়লাভ করেন।
এরপর আবু বকর রা. মদীনা থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত যুলকাসসা নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। এখানে তিনি মুজাহিদ বাহিনীকে ১১ টি ভাগে বিন্যস্ত করেন।
প্রতিটি ভাগে একজন করে অভিজ্ঞ আমির নিযুক্ত করেন। এরপর আবু বকর রা. যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে এই ১১ বাহিনীকে আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে দেন।
এই একেকটি বাহিনী একেক গোত্রের মুরতাদদের উপর চড়াও হয়।
মিথ্যা নবুয়তের দাবীদারদের বিরুদ্ধে আবু বকর রা. এর অভিযান
হযরত আবু বকর রা. এর যুগে আরবের বিভিন্ন দিক থেকে মিথ্যা নবুয়তের দাবী করার হিড়িক পড়ে যায়। মানুষ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে তাদেরকে নবী হিসেবে মান্য করা শুরু করে।
আবু বকর রা. এই সংবাদ পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি সাহাবাদের দল গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।
আসওয়াদ আনাসি এর ফেতনা
সময়টা ছিল রাসূলের শেষ জীবনে। চারিদিকে ইসলামের জয়-জয়কার। দলে দলে মানুষ মুসলমান হচ্ছে। কেউ বা মুসলমানদের এমন উত্থান দেখে ভয়ে ভয়ে ও ইসলাম গ্রহণ করেছে।
ইয়ামেনে আসওয়াদ আনাসির নবুয়ত দাবী
আসওয়াদ যখন শুনতে পায় নবীজি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখনই সে নবুয়তের দাবী করে বসে। সে নিজেকে রাহমানুল ইয়ামান বলে দাবী করতো।
সে বলতো, নবী সা. ও নবী। আমিও নবী। তার নিকট নাকি সাহিক ও শাকিক নামে দুজন ফেরেশতা আসতো।
প্রথমদিকে সে নবুয়তের দাবী গোপন রেখে লোকজনকে নিজের পাশে জড়ো করে। যখনসে বুঝতে পারে যে,
এখন যথেষ্ঠ জনসমর্থন আছে, তখনই সে নবুয়তের দাবী করে বসে।
সে ছিল আনাস গোত্রের সদস্য। সর্বপ্রথম আনাস গোত্রের যুবকরা তার ডাকে সাড়া দেয়। এরপর আশেপাশের আরো অনেক গোত্র তাকে সমর্থন করে।
আসওয়াদ আনাসির ডাকে যারা সাড়া দিয়েছিল, তারা নামে মুসলমান হলেও তারা মূলত সন্তুষ্টিচিত্তে মুসলমান হয় নি।
তারা ইসলামের এমন উত্থান দেখে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মুসলমান হয়।
আসওয়াদ আনাসির ইয়ামেন দখল
রাসূলের যামানায় ইয়ামেনের রাজধানী সানাআর গভর্নর ছিল, শাহার বিন বাজান রা.। সানাআয় আসওয়াদ আনাসির সাথে শাহার রা. এর তুমুল যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে শাহার রা. শাহাদাতবরণ করেন। সানাআবাসী পরাজিত হয়।
আসওয়াদ আনাসির মুসলিম বিদ্বেষ
আসওয়াদ আনাসি মুসলমানদের সহ্য করতে পারতো না। সে মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যা করতো।
সে মুসলমানদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু ভয়ানক পদ্ধতি অবলম্বন করে।
একবার নুমান নামে এক মুসলমানকে ধরে এনে একটি একটি করে অঙ্গ কেটে হত্যা করে। এই ঘটনার পর তার অধীনে থাকা মুসলমানরা নিজেদের ইসলাম গোপন রাখে।
ফারওয়া ইবনে মুসাইক রা. নবীজির নিকট আসওয়াদ আনাসির ব্যাপারে পত্র লিখেন। নবীজি তখন জানতে পারেন এই মুরতাদের কথা।
এদিকে আবু মুসা আশআরী রা. এবং মুআজ ইবনে জাবাল রা. সাকাকিক ও সাকুন এলাকার পাশে এসে জমায়েত হন।
রাসূল সা. সেখানকার মুজাহিদদের নির্দেশ দেন, যে কোনোভাবেই হোক, যেন আসওয়াদ আনাসিকে হত্যা করা হয়।
আসওয়াদ আনাসির সাথে যুদ্ধ
ইয়ামানে তখন মুসলিম সেনাপতিরা একত্রিত হলো। তারা নবীজির দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
অবশেষে যুদ্ধে মুসলমানরা জয়লাভ করে পুনরায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেয়।
আসওয়াদ আনাসিকে হত্যা
হযরত ফিরোজ দাইলামি রা. একরাতে আসওয়াদের ঘরে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করেন। এই খবর আল্লাহ তা’আলা ওহীর মাধ্যমে নবীজিকে জানিয়ে দিলেন।
তখন তিনি উপস্থিত লোকদের সুসংবাদ জানিয়ে বললেন, বরকতময় ঘরের বরকতময় ব্যক্তি আসওয়াদকে হত্যা করেছে।
নবীজিকে তখন জিজ্ঞাসা করা হয়, কে তিনি?
নবীজি বললেন, ফিরোজ।
এই ঘটনার কিছুদিন পর নবীজি ইন্তিকাল করেন। আর নবীজি এটা ওহীর মাধ্যমে জেনেছিলেন। কোনো লোক মারফতে নয়।
তাই এই খবর বাহিরের তেমন কেউ জানতো না। হযরত আবু বকর রা. খেলাফতের মসনদে আরোহণের পর সর্বপ্রথম ইয়ামেন থেকে দূত এসে আসওয়াদ আনাসির হত্যার বিস্তারিত সুসংবাদ দেয়।
তাই আবু বকর রা. এর নিকট এটাই ছিল সর্বপ্রথম সুসংবাদ।
তুলায়হা আসাদি এর ফেতনা
রাসূল সা. এর ইন্তিকালের পর বনু আসাদ গোত্রের সরদার তুলাইহা আসাদি নবুয়তের মিথ্যা দাবী করে।
সে তার গোত্র এবং আশেপাশের গোত্র মিলিয়ে অনেক অনুসারী জমা করে ফেলেছিল। সে দাবী করতো, জিবরাইল আ. তার নিকট ওহী নিয়ে আসেন।
রাসূলের জীবনের শেষ সময় তুলায়হা
নবী কারীম সা. এর ইন্তিকালের পূর্বে সে একদল প্রতিনিধিসহ রাসূলের নিকট আসে। মদীনায় পৌছে সে রাসূল সা. কে সালাম দেয়।
এরপর সে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে গিয়ে বলে, আমরা নিজে থেকে আপনার খেদমতে এসেছি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতিত কোনো মাবুদ নেই এবং আপনি তার বান্দা ও রাসূল।
কিন্তু আল্লাহ আমাদের কাছে কাউকে পাঠান নি। আমরা আমাদের পেছনে থাকা লোকদের জন্য যথেষ্ঠ।
এরপরেই আল্লাহ তা’আলা সূরা হুজরাতের ১৭ নং আয়াত অবতীর্ণ করেন,
یَمُنُّوۡنَ عَلَیۡکَ اَنۡ اَسۡلَمُوۡا ؕ قُلۡ لَّا تَمُنُّوۡا عَلَیَّ اِسۡلَامَکُمۡ ۚ بَلِ اللّٰهُ یَمُنُّ عَلَیۡکُمۡ اَنۡ هَدٰىکُمۡ لِلۡاِیۡمَانِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ
“তারা ইসলাম গ্ৰহণ করে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা ইসলাম গ্ৰহণ করে আমাকে ধন্য করেছ মনে করো না। বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন। যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”
এরপর তুলায়হা প্রতিনিধিদল নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসে এবং একটা সময় সে নবুয়তের দাবী করে বসে। কিন্তু এবার সে ফাঁদে পড়ে যায়।
তুলায়হা বুঝতে পারে, মুসলমানদের সঙ্গে তার সংঘাত অনিবার্য। সে তখন সামিরা অঞ্চলকে নিজের ঘাঁটি বানিয়ে নেয়।
সাধারণ মানুষের নিকট সে তার নবুয়তের দাবী ছড়াতে থাকে। অনেকেই তার ফাঁদে পা দিযে বসে।
মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য সে ভেলকিবাজি প্রদর্শন করতো।
তুলায়হার ভেলকিবাজি
একবার কিছু লোক তার সঙ্গে সফরে ছিল। পথিমধ্যে তাদের সাথে থাকা পানি শেষ হয়ে যায়। মরুভূমিতে প্রচন্ড পিপাসায় তারা কাতরাতে থাকে।
তখন সে তার অনুসারীদের বলে, তোমরা ঘোড়ায় চড়ে কয়েক মাইল সামনে অগ্রসর হও। সেখানে পানির মটকা দেখতে পাবে।
লোকেরা সেখানে গিয়ে দেখে, সত্যি পানির মটকা রয়েছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ এটাকে তুলায়হার মোজেজা ভেবে বসে।
তুলায়হা বিভিন্নরকম ভেলকিবাজির মাধ্যমে বনু আসাদ, বনু গাতফান, বনু তায়ীর লোকদের বিভ্রান্ত করে ফেলে।
এর ফলে এই গোত্রের লোকেরা মদীনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
তুলায়হার ওহী
তুলায়হা দাবী করতো, তার নিকট জিবরাইল আ. আসে। সে কিছু মনগড়া আয়াত মানুষের নিকট বলে বেড়াতো। যেমন,
والحمام واليمام والصرد الصوام قد صمن قلبكم بأعوام ليبلغن ملكنا بالشام
অর্থ: শপথ শহুরে এবং জংলি কবুতর এবং রোজাদার শিকারী পাখির। তারা তোমাদের কযেক বছর পূর্বেই রোজা রেখেছে। আমার রাজত্ব শাম পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
তুলায়হার বিরুদ্ধে আবু বকর রা. এর অভিযান
হযরত আবু বকর রা. তুলায়হার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য সেনাপ্রধান হিসেবে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে নির্বাচন করেন।
তুলায়হা তখন তার বাহিনীর সাথে বুযাখ নামক স্থানে অবস্থান করছিল। হযরত আবু বকর রা. খালিদকে পাঠানোর সময় এই নির্দেশ দেন যে,
“তুমি প্রথমে তায়ী গোত্রের নিকট যাবে। এরপর বুযাখের দিকে যাত্রা করবে। এই দায়িত্ব শেষ করার পর বিতাহে বনু তামিমের মালেক বিন নুয়াইরার খরব নিবে।
এরপর আমার নির্দেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।”
আবু বকর রা. এই নির্দেশের ফলে খালিদ রা. প্রথমে তায়ী গোত্রের সাথে যোগাযোগ করেন।
তারা তখনো ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের কিছু লোক বিভ্রান্ত হয়ে তুলায়হার অনুসারী হয়েছিল।
বনু তায়ীর সরদার আদি বিন হাতেম খালিদ রা. এর নিকট তিনদিন সময় চান। এই সময়টায় আদি রা. তার গোত্রকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন।
শেষ পর্যন্ত আদি বিন হাতেম রা. এর প্রচেষ্টায় তার গোত্র তুলায়হার সঙ্গ ছেড়ে দিয়ে খালিদ রা. এর বাহিনীতে যোগদান করে।
হযরত আবু বকর রা. এর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার সফলতা ছিল এটা। দেখা যায়, যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে শত্রুসারিতে ভীতি ছড়িয়ে যায়।
তুলায়হার সাথে খালিদ রা. এর যুদ্ধ
বুযাখা নামক স্থানে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। জায়গাটি ছিল মদীনা থেকে ৪০০ কি.মি. দূরে।
তুলায়হা আসাদি তখন চাদর মুড়ি দিয়ে মুরাকাবার সূরতে এমনভাবে বসে, যেন মনে হচ্ছে তার উপর ওহী নাযিল হবে।
তার বাহিনীর সেনাপ্রধান ছিল উয়াইনা বিন হিসিন। তার অধীনে বনু ফাযারার ৭০০ যোদ্ধা ছিল। মুসলমানদের উপর তুলায়হার বাহিনী আক্রমণ করে বসে।
উয়াইনা মুসলমানদের আক্রমণ দেখে ভড়কে যায়। সে বুঝতে পারে, খালিদ রা. কে হারানো বেশ কঠিন।
সে তখন তুলাইহার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে,
জিবরাইল কি কোনো বার্তা নিয়ে এসেছে? তুলাইহা বললো, আসে নি। আস্তে আস্তে উয়াইনা পরাজয়ের রক্তিম আভা দেখতে থাকে।
তখন সে তুলায়হার নিকট এসে বলে, তোর বাপের মৃত্যু হোক। এতক্ষণ লাগে জিবরাইলের আসতে?
তুলাইহা বললো, জিবরাইল না এলে আমি কি করবো?
উয়াইনা তার বাহিনীকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখে। কিন্তু তারা ময়দানে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারছিল না। তারা দলে দলে মৃত্যুবরণ করছিল।
উয়াইনা এবার পাগলের মতো ছুটে এসে তুলায়হাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, এবার কি আসছে?
তুলাইহা বললো, হ্যাঁ এসেছিল। উয়াইনা উচ্ছ্বাসিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি বললো তিনি?
উয়াইনা তখন মনগড়া একটা আয়াত বলে, “তোমার ভাগ্যে তার মতো একটি চাক্কি নসিব হবে।
তোমার অবস্থা এমন হবে যে, তুমি চিরকাল তা স্মরণ রাখবে।”
এমন উল্টাপাল্টা কথা শুনে উয়াইনা বুঝে যায়, সে মিথ্যা নবুয়তের দাবীদার। তখন সে বাহিনীর নিকট এসে ঘোষণা দিয়ে বললো,
লোকসকল, তোমরা পালিয়ে যাও। এই লোক একটা মিথ্যুক এবং ধোঁকাবাজ। সে মিথ্যা নবুয়তের দাবী করেছে।
তখন উয়াইনার লোকজন পলায়ন করতে থাকে। মুরতাদরা পরাজয়বরণ করে। হযরত খালিদ রা. উয়াইনাকে গ্রেপ্তার করেন।
মিথ্যা নবুয়তের দাবীদার উয়াইনা আগে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ঘোড়া তৈরি করে রেখেছিল।
সে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পলায়ন করে শামে চলে যায়।
তুলাইহার তওবা
এরপর তুলায়হা আসাদি কিছুদিন এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে অবশেষে সে হযরত আবু বকর রা. এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে দ্বিতীয়বার ইসলাম গ্রহণ করে।
আবু বকর রা. তার তওবা করা দেখে সাদরে গ্রহণ করে নেন। এরপর তুলায়হা আসাদি ইরাকে একজন মুসলিম যোদ্ধা হিসেবে জীবন অতিবাহিত করে।
এদিকে তুলাইহার সেনাপতি উয়াইনাও তওবা করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নেয়। তাকেও ক্ষমা করে দেয়া হয়।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাব এর ফেতনা
নবীজির জীবদ্দশাতেই নবুয়তের দাবীদাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফেতনাবাজ ছিল মুসায়লামা। সে ছিল বনু হানিফা গোত্রের সদস্য।
তার পূর্ণ নাম, মুসায়লামা ইবনে সুমামা ইবনে কাবির ইবনে হাবিব হানাফি। তার ডাকনাম আবু শামাহ। মুসায়লামা জন্মগ্রহণ করে ইয়ামামায়। সেখানেই সে বেড়ে উঠে।
ইয়ামামার অবস্থান আধুনিক সৌদি আরবের দক্ষিণ-পূর্ব নজদের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল, বা কখনও কখনও আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে,
আল- খার্জের নিকটে জাউ আল-ইয়ামামাহের অধুনা-বিলুপ্ত প্রাচীন একটি গ্রাম। যা পরবর্তীতে আশেপাশের অঞ্চলও এই নামে প্রসিদ্ধলাভ করে।
মুসায়লামার ভ্রমণ ও জ্ঞানলাভ
মুসায়লামা আরব-অনারবসহ প্রায় অনেক অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিল। সে মানুষকে আকর্ষণ করার বিদ্যা ভালোভাবেই রপ্ত করে।
তার শিক্ষক ছিল তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত পুজারী, পুরোহিত, জ্যোতিষী, গণক, জাদুকররা। সে এমন কিছু অদ্ভুত জ্ঞান জানতো, যার দ্বারা মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে সক্ষম।
সে পাখির কাটা পাখা তার ডানায় জুড়ে দিতে পারতো। ডিমকে বোতলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারতো। মুসায়লামা রাসূলের জীবদ্দশাতেই নবুয়তের দাবী করে বসে।
সে মক্কায় কুরআন শেখার জন্য লোক পাঠাতো। যাতে সে তাদের থেকে শুনে সে রকম অন্য আয়াত বানিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারে।
মুসালামাতুল কাজ্জাবের কিছু মনগড়া আয়াত
“শপথ বকরি এবং তার রংয়ের। তার মধ্যে কালো বকরি এবং তার সাদা দুধ সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। বকরি কালো কিন্তু তার দুধ সাদা।
এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা। দুধের সাথে পানি মেশানো হারাম করা হয়েছে। তোমাদের কি হলো যে, তোমরা দুধের সাথে খেজুর খাও না?”
আরেকটি আয়াত হলো,
“হে ব্যাঙ, ব্যাঙের বাচ্চা, তুমি যাকে পরিষ্কার রাখ তা পরিষ্কার থাকে। তোমার মাথা পানির উপরে আর নিতম্ব কাদা মাটিতে।
তুমি পানকারীকে বাধা দিও না। আর পানিও বিনষ্ট করো না।”
এমন আরো বেশ কিছু আয়াত সে বানিয়েছিল। যা বাহ্যিকভাবে মানুষকে সম্মোহিত করলেও তা থেকে কোনোরুপ শিক্ষা হাসিল করা যেত না।
রাসূলের নিকট মুসায়লামার দূত
দশম হিজরীতে রাসূল সা. যখন অসুস্থ পড়ে পড়লেন তখন মুসায়লামা নবীজির নিকট দূত প্রেরণ করে।
সে এই পত্রটি উবাদা ইবনে হারিস হানিফীর মাধ্যমে পাঠায়।
পত্রটিকে বলা হয়েছিল, মুহাম্মাদুর রাসূলের নিকট আল্লাহর রাসূল মুসায়লামার পক্ষ থেকে।
অর্ধেক ভূ-খণ্ড আমাদের। অর্ধেক ভূ-খণ্ড কুরাইশদের। কিন্তু কুরাইশরা আমাদের সঙ্গে ইনসাফ করছে না।
নবীজি তখন প্রত্রের জবাব দেন এভাবে, আল্লাহর নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মুসায়লামা কাজ্জাবের নিকট, জমিন আল্লাহর। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে থাকেন।
নবীজি তখন দূতকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা কি বলো?
দূত জবাব দেয়, মুসায়লামা যা বলে আমরাও তাই বলি।
নবীজি তখন বললেন, যদি আমি দূত হত্যা করা সঠিক মনে করতাম তাহলে তোমার ঘাড় মটকে দিতাম।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের নিকট রাসূলের দূত
রাসূল সা. মুসায়লামার নিকট হযরত হাবিব ইবনে জায়েদ রা. কে প্রেরণ করেন। মুসায়লামাতুল কাজ্জাব তখন তাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি বিশ্বাস করো মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল?
হাবিব রা. বললেন, হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি।
এরপর মুসায়লামা বললো, তুমি কি এটা বিশ্বাস করো যে, আমি আল্লাহর রাসূল?
তখন হাবিব রা. না বুঝার ভান করে বললেন, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাব তখন হাবিব রা. এক একটি অঙ্গ কেঁটে তাকে হত্যা করে।
মুসায়লামার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. খেলাফতের মসনদে আরোহনের পর মুসায়লামাকে দমন করার জন্য প্রথম ইকরিমা বিন আবু জাহেল রা. এর নেতৃত্বে পাঠান।
কিছুদিন পর দ্বিতীয়তে হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা রা. এর নেতৃত্বে আরো একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। হযরত আবু বকর রা. ইকরিমা রা. কে নির্দেশ দেন যে,
যতক্ষণ না শুরাহবিল তোমার নিকট না পৌছবে ততক্ষণ তুমি যুদ্ধ শুরু করবে না। কিন্তু ইকরিমা রা. এই নির্দেশনার উপর কাজ না করে নজদে পৌছেই আক্রমণ করে বসেন।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাব এর বাহিনী ছিল যুদ্ধবাজ বাহিনী। তারা হযরত ইকরিমা রা. এর বাহিনীকে পরাজিত করে পিছু হটতে বাধ্য করে।
আবু বকর রা. এর নিকট ইকরিমা রা. এই সংবাদ পাঠান। তখন আবু বকর রা. শুরাহবিল বিন হাসানা রা. কে থামিয়ে দেন।
তাদেরকে বললেন, তোমরা খালিদ বিন ওয়ালিদের বাহিনী আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।
আবু বকর রা. মুসায়লামার সামরিক শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এদিকে খালিদ রা. তুলাইহা ফেতনা দমন করে মদীনায় আসেন।
হযরত আবু বকর রা. তৎক্ষণাৎ তাকে মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান করে পাঠান।
মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধ
হযরত আবু বকর রা. খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে পাঠালেন ইয়ামামার ময়দানে। মুসায়লামার হাতে শহীদ হওয়া হযরত হাবিব বিন যায়েদ রা. এর মা উম্মে উমামা রা. ও নিজের আরেক সন্তান আব্দুল্লাহ বিন যায়েদের সাথে এই বাহিনীতে যোগদান করলেন।
মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে বনু হানিফার ৪০ হাজার যোদ্ধা আকরাবা ময়দানে সারিবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
ইয়ামামার অনেক যাযাবর গোত্র সে সময় ইসলাম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. তাদেরকে পুনরায় ইসলামে পথে আনার চেষ্টা করেন।
তাদের মধ্য থেকে কেউ সেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে আর কেউ বা সাম্প্রদায়িতার উষ্কানীতে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়।
খালিদ রা. তাদেরকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে সামনে অগ্রসর হন।
মুসায়লামা ও খালিদ রা. এর বাহিনী বিন্যাস
মুসায়লামাতুল কাজ্জাব আকরাবা ময়দানে বাহিনী প্রস্তুত করে। মুসায়লামা তার বাহিনীর ডানে ও বামে যথাক্রমে মুহকাম ইবনে তুফায়েল এবং রাজ্জাল ইবনে উনফুয়াকে সেনাপতি নিযুক্ত করে।
এদিকে খালিদ রা. এর অগ্রবাহিনীতে প্রধান হিসেবে ছিলেন শুরাহবিল বিন হাসানা রা. ।
আর সেনাবাহিনীর ডানে ও বামে ছিলে যায়েদ বিন খাত্তাব রা. ও আবু হুজাইফা ইবনে উতবা ইবনে রাবিআ রা.।
ইয়ামামার মুসলমানদের খালিদ রা. এর সাথে যোগদান
ইয়ামামায় মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের উত্থানের পর ইরতিদাদ এমনভাবে প্রচার করা হয় যে, মনে হয় সেখানে কোনো মুসলমান ছিল না।
সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও সেখানে মুসলমানরা ছিল। তাদের মধ্য থেকে অন্যতম হলেন হযরত সুমামা ইবনে উসাল হানিফা রা.।
ইয়ামামার মুসলমানরা যখন জানতে পারে, খালিদ রা. বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তখন তারা সুমামা রা. এর পাশে জড়ো হয়।
সুমামা রা. ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও চৌকষ ব্যক্তি। ইয়ামামায় আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন হযরত মা’মার ইবনে কিলাব রুমানি রা.।
এরপর এই ব্যক্তিরা অন্যন্য মুসলমানদের নিয়ে খালিদ রা. এর নিকট গমন করেন। খালিদ রা. তাদেরকে নিজ বাহিনীতে যুক্ত করে নেন।
ইয়ামামার চূড়ান্ত যুদ্ধক্ষেত্র
দুই বাহিনীতে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। বনু হানিফার লোকেরা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার কারণে মিথ্যাবাদী নবীর জন্য অসম্ভব আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে লড়াই করতে থাকে।
মুসলমানগণ ইতিপূর্বে এমন মারাত্মক আক্রমনের শিকার হন নি। কয়েকজন প্রসিদ্ধ সাহাবী এক এক করে শহীদ হয়ে যান।
যুদ্ধের ময়দানের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। একবার মুসলমানরা বিজয়ী হতো আরেকবার কাফেররা। একবার মুসলমানদের পা উপড়ে যায়।
মুসায়লামার বাহিনী তাদেরকে তাড়াতে তাড়াতে তাবু পর্যন্ত নিয়ে আসে। হযরত সাবেত বিন কায়েস রা. মুসলমানদের এই অবস্থা দেখে চিৎকার করে বললেন,
হে আল্লাহ আমি মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপনার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। এরপর তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান।
একে একে হযরত সালেম, হযরত আবু হুফায়ফা, হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব রা. প্রত্যেকেই শহীদ হয়ে যান।
হযরত খালিদ রা. মুসলিম বাহিনীকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করেন। তারপর প্রবলবেগে আক্রমণ করেন। এতে শত্রুদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়।
মিথ্যা নবীর অনুসারীরা তখন দিগইবদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পলায়ন করতে থাকে। যুদ্ধের ময়দান থেকে অল্প কিছু দূরেই একটা বাগান ছিল।
ইয়ামামার যুদ্ধকে মৃত্যুর বাগান বলা হয় কেন
তারা বাগানে পলায়ন করে মোর্চা তৈরি করে। হযরত বারা বিন মালিক রা. বারবার বলতে থাকেন, যেন তাকে বাগানে নিক্ষেপ করা হয়।
যাতে তিনি সেখানে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা খুলতে পারেন। তার ইচ্ছানুযায়ী তা করা হয়। এর মধ্যেই তার শরীরে আশির অধিক আঘাত লাগে।
মুসলমানরা বাগানে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। এই স্থানে বিখ্যাত বদরী সাহাবী হযরত আবু দুজানা রা. শহীদ হয়ে যান।
উম্মে উমারা ও তার ছেলে আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ রা. ভেতরে প্রবেশ করেন। এক ব্যক্তি উম্মে উমারার হাত কেঁটে ফেলে।
তা সত্ত্বেও তিনি ময়দানে সাহসীকতার সাথে লড়াই করে যান।
শেষ পর্যন্ত শত্রুরা বাগান থেকেও পলায়ন করতে থাকে। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক চলে যায়। মুসায়লামাতুল কাজ্জাব ও তখন পলায়ন করতে থাকে।
মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের মৃত্যু
হযরত ওয়াহশি বিন হারব রা. আগে থেকেই তার বর্শা নিয়ে ওৎ পেতে ছিলেন।
তিনি তার বর্শা নিজস্ব ভঙ্গিতে এমনভাবে ছুড়ে মারেন যে, মুসালমার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়।
সেখানেই সে নেতিয়ে পড়ে। এ সময় উম্মে উমারা ছেলে আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ রা. তরবারির মাধ্যমে তার মাথা আলাদা করে ফেলেন।
ইয়ামামার যুদ্ধে কতজন শহীদ হন
এই প্রলয়ঙ্কারী যুদ্ধে মদীনার মুহাজির ও আনসার মিলিয়ে ৩৬০ জন সাহাবী শাহাদাতলাভ করেন। যাদের মধ্যে ৩৫ জন কুরআনের হাফেজ ছিল।
অন্যদিকে মুসায়লামার বাহিনীর সাত হাজার সৈন্য ময়দানে ও সাত হাজার সৈন্য বাগানে মৃত্যুবরণ করে। আর বাকীরা এদিক ওদিক পালিয়ে যায়।
হিজরি কত সালে ইয়ামামার যুদ্ধ সংঘটিত হয়
ইয়ামামার যুদ্ধ ১১ হিজরীর শেষের দিকে সংগঠিত হয়। এটা আরব ভূখণ্ডে তৈরী হওয়া সর্বশেষ বড় ফেতনা ছিল।
এরপর মুরতাদদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর সেনাপতিগণ আরবের সকল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দমন করেন।
আবু বকর সিদ্দিক রা. মুতরিফ বিন নুমান রা. কে ইয়ামামার গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন হযরত সুমামা বিন উসাল রা. এর ভাতিজা।
সর্বপ্রথম কুরআন সংকলনের উদ্যোগ
ইয়ামামার যুদ্ধে প্রায় ৩৫ জনের অধিক হাফেজ শাহাদাতলাভ করেন। এত বিপুল সংখক হাফেজের ইন্তিকালে আবু বকর রা. পেরেশান হয়ে যান।
তখন পর্যন্ত কুরআন শরীফ লিখে রাখার প্রচলন চালু হয় নি। সে সময় মানুষ শুনে শুনে কুরআন মুখস্ত করতো।
হযরত আবু বকর রা. এত সংখক হাফেজের শাহাদাতের কারণে কুরআন মাজিদ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা করতেন।
এ জন্য তিনি সর্বপ্রথম কুরআন মাজিদ লিখিত আকারে একত্রিত করার ইচ্ছাপোষণ করেন। প্রথমে তিনি ওমর রা. এর নিকট এই মত পেশ করেন।
দায়িত্ব
হযরত আবু বকর রা. কুরআন মাজিদ সংকলনের জন্য অন্যতম আনসারি সাহাবী হযরত যায়েদ বিন সাবেত রা. কে দায়িত্ব প্রদান করেন।
হযরত যায়েদ রা. ছিলেন একজন কাতেবে ওহী। তিনি রাসূলের যামানায় কুরআন মাজিদ লিখে রাখতেন।
পাশাপাশি জ্ঞান-গরিমায় তিনি ছিলেন অতুলনীয় একজন ব্যক্তি।
কোন তারতীবে কুরআন সংকলন করা হলো
নবীজি সা. এর নবুয়তের পুরো ২৩ বছর ধরে কুরআন মাজিদ নাযিল হয়েছে। আর এই কুরআন কখনো প্রেক্ষাপ্রটে, কখনো বা উপদেশ হিসেবে, কখনো বা ভীতি প্রদর্শন হিসেবে নাযিল হয়েছে।
তাই ওহীর তারতীব অনুযায়ী কুরআন সংকলন করা ছিল ভীষণ কঠিন কাজ।
প্রকারান্তরে হযরত জিবরাইল আ. নবীজির নিকট লওহে মাহফুজের তারতীব অনুযায়ী কুরআনের পূর্ণাঙ্গ তারতীব বলে দিয়েছেন।
কিন্তু সেই তারতীব সম্পূর্ণ ওহী সমাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জানা সম্ভব ছিল না।
কারণ, রাসূলের যামানায় কুরআন বিভিন্ন চামড়া, গাছের ছাল অথবা বিভিন্ন মাধ্যমে লিখে রাখার প্রচলন ছিল।
রাসূল সা. লওহে মাহফুজের ক্রমানুধারা অনুযায়ী তেলওয়াত করতেন। আর সেটাই অনেক সাহাবারা রপ্ত করে নিয়েছিলেন।
যায়েদ বিন সাবেত রা. এর সংকলন
হযরত যায়েদ বিন সাবেত রা. এই সকল লিখিত উপকরণ এবং হাফেজদের স্মৃতি কাজে লাগিয়ে কুরআন শরীফের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কপি তৈরি করেন।
এরপর সেই কপি যায়েদ বিন সাবেত রা. আবু বকর রা. এর নিকট হস্তান্তর করেন। হযরত আবু বকর রা. এর এই কপি সংরক্ষণ করা হয়।
কুরআন মাজিদের সংকলনকৃত এই কপিটি আবু বকর রা. এর পর ওমর রা. এর নিকট আসে।
হযরত ওমর রা. এর শাহাদাতলাভের পর উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা রা. এর নিকট কপিটি সংরক্ষিত থাকে।
খলিফা উসমান রা. এর শাসনামলে কুরআন সংকলন
খোলাফায়ে রাশেদার তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান রা. এর যামানায় অভিযোগ আসে যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ কুরআন মাজিদের ব্যাপারে মতানৈক্যের শিকার হচ্ছে।
তখন উসমান রা. হাফসা রা. এর নিকট থেকে যায়েদ রা. এর সংকলনকৃত কপিটি চেয়ে আনেন।
এরপর তিনি কুরআন মাজিদের ব্যাপারে দক্ষ সাহাবাদের আরো কতগুলো কপি তৈরি করার নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে সেই সংকলনকৃত কপিগুলো মুসলিমবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
আবু বকর রা. এর শাসনামলে পারস্য অভিযান
পারস্য বা ইরান সে সময় ছিল বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একটি। তাদের সাথেই ছিল আরবের সীমানা।
পারস্যের ক্ষমতাধররা আরব সীমান্তের অধীবাসীদের উপর জুলুম নির্যাতন করতো।
খলিফা আবু বকরের সময় পারস্যের রাজনৈতিক ময়দানে ধস নামে। এর ফলে তাদের সেনাব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে যায়।
পারস্যের পাশে উক্ত আরব সীমান্তের অধিবাসীদের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত মুসান্না বিন হারিসা রা.।
তিনি নবম হিজরীতে ইসলাম গ্রহন করেন। সে সময় সীমান্তের আবররা পারস্যের উপর গেরিলা আক্রমন করতো।
হযরত আবু বকর রা. এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অবগত হলেন।
তখন থেকে তিনি সীমান্ত এলাকার খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। মুসান্না বিন হারিসা রা. আবু বকরকে বললেন,
আমাকে কিছু সৈন্য দিন। কারণ, পারস্যের শক্তি শেষ হয়ে গেছে।
মুজাহিদ বাহিনী গঠন
তখন মুসান্না বিন হারিসা ভাবলেন, এখন যদি বড় একটা বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে পারস্য জয় করাটা তেমন কঠিন কিছু নয়।
তাই তিনি নিজেই মদীনায় এসে পারস্য আক্রমনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। পাশাপাশি তিনি মুজাহিদ বাহিনীও চাইলেন।
আবু বকর রা. তখন আট হাজার মুজাহিদ দিয়ে মুসান্না বিন হারিসাকে সাহায্য করেন।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে সেনাপতি নিযুক্তকরণ
হযরত আবু বকর রা. অনুভব করলেন, পারস্যের মতো এক বড় এক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একজন দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পূর্ণ সেনাপ্রধান দরকার।
তখন তার দৃষ্টি হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এর উপর পড়ে।
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. খতমে নবুয়ত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে অসাধারণ সফলতার সাথে জিহাদ পরিচালনা করেছিলেন।
আবু বকর রা. তখন তাকে পারস্য অভিমূখে তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে বললেন।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. নিজের সাহাযের জন্য অন্য কাউকে পাঠাতে বললেন। তখন আবু বকর রা. কা’কা বিন আমর রা. কে তার সহায়তায় পাঠান।
কা’কা বিন আমর রা. ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত দূত ও যুদ্ধের ময়দানে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন।
সেনাদলের অবস্থান
উক্ত সেনাদলগুলো এসে উবুল্লা নামক স্থানে একত্রিত হয়।
বর্তমানে উবুল্লা হলো ইউফ্রেটিস – টাইগ্রিস মোহনার ডান তীরে পারস্য উপসাগরে প্রবেশময় অবস্থিত। এটি পুরাতন বসরার পূর্বে অবস্থিত এবং নাহর আল-উবুল্লা নামক খালের উত্তর দিকে অবস্থিত।
যা বসরাকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে টাইগ্রিস নদী, আবাদান (আধুনিক ইরানে) এবং শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত করেছে।
পারস্য উপসাগর আধুনিক বসরার আশর পাড়া বর্তমানে আল-উবুল্লার জায়গা দখল করে আছে।
উক্ত স্থান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেখানে অবস্থানকারী সেনারা চাইলে আরব ও ইরাক কবজা করার পাশাপাশি সমুদ্রেপথে ভারত উপমহাদেশেও অভিযান পরিচালনা করতে পারতো।
ইরাকের এই পয়েন্টটি পারস্যের গভর্নর হরমুজের শাসনাধীন ছিল। সে ছিল অনেক বদকার লোক। সে অসহায় জনগণের উপর নির্যাতন করতো।
খালিদ রা. এর হুমকি
খালিদ রা. হরমুজকে চিঠি লিখে বলে, তোমার সামনে তিনটা পথ খোলা আছে। হয় তুমি ইসলাম গ্রহন করবে। কিংবা তুমি জিজিয়া কর দিয়ে আমাদের নিরাপত্তায় চলে আসবে।
অন্যথায় যুদ্ধের ময়দানে আমাদের সাথে শক্তি পরীক্ষায় নামতে হবে।
আর তোমাকে হত্যা করার জন্য আমার নিকট এমন এক বাহিনী আছে, যারা আল্লাহকে ভালোবাসে। যেমনটা তুমি মদপান করতে ভালোবাসো।
হরমুজের প্রতিক্রিয়া
হরমুজ খালিদ রা. এর চিঠিটি পাওয়ার পর সেটা পারস্যের রাজধানী মাদায়েনে পাঠিয়ে দেয়। তখন পারস্যের সম্রাট ছিল আরদশির।
এরপর হরমুজ তখন বিশাল বড় সেনাবাহিনী নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বের হয়।
সাথে ছিল পারস্যের প্রসিদ্ধ শাহজাদা ও নামকরা পালোয়ানরা। হরমুজ তার সৈন্যদের পায়ে শেকল বেঁধে দেয়। যাতে তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন না করে।
এই যুদ্ধটি ছিল আবরদের সাথে অনাবরদের প্রথম যুদ্ধ। তাই বেশ ঘটা করেই প্রস্তুতি নেয়া হয়।
যাতুস সালাসিল যুদ্ধ
যুদ্ধের সারিতে দাঁড়ানোর পর হযরত খালিদ রা. ময়দানের মাঝখানে এসে মল্লযুদ্ধের আহবান জানান। হরমুজ তখন এগিয়ে আসে।
যখন হরমুজ ও খালিদ রা. পরষ্পর সামনাসামনি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তখনই দুই বাহিনীর মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
কাফেরদের একটা অংশ হযরত খালিদ রা. এর উপর আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হয়। সে সময় হযরত কা’কা বিন আমর রা. তাদেরকে পিছু হটিয়ে দেন।
দীর্ঘক্ষণ মল্লযুদ্ধ হওয়ার পর হযরত খালিদ রা. হরমুজকে হত্যা করেন। তাকে হত্যার পর পরই কাফেরদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে যায়। তারা পলায়ন করতে থাকে।
তাদের পালোয়ানরা ও সৈন্যরা পায়ের শেকল ভেঙ্গে ভেগে যেতে থাকে। মুসলিমরা তাদের পিছু নিয়ে অসংখ্য সৈন্যদের হত্যা করেন।
এটি হলো ১২ হিজরীর শুরুর দিকের ঘটনা। এই যুদ্ধের নামকরণ করা হয় যাতুস সালাসিল নামে। অকল্পনীয় এই বিজয়ে পুরো মুসলিম বিশ্বে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়।
ছান্নির যু্দ্ধ
হরমুজের সৈন্যরা পলায়ন করতে করতে ছান্নি নামক স্থানে চলে যায়। সেখানে তখন পারস্যের অন্যতম জেনারেল কারিন অবস্থান করছিল।
সে যখন জানতে পারে, হরমুজ পরাজিত হয়েছে তখন সে ছান্নির ময়দানে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
হযরত খালিদ রা. অগ্রসর হয়ে ছান্নির নিকটে চলে আসেন। সেখানে আবার কাফেরদের সাথে যুদ্ধ হয়।
এই যুদ্ধে জেনারেল কারিন নিহত হয় এবং প্রায় ত্রিশ হাজার কাফের সৈন্য নিহত হয়।
অলাজার যুদ্ধ
পর পর দুইটি পারসিক বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ পৌছে পারস্যের রাজদরবারে।
বেদনায়, হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় তারা। তখন আন্দারযাগর ও বাহমান জাদাবিয়া বিশাল সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বের হয়। এটা ১২ হিজরীর সফর মাসের ঘটনা।
হযরত খালিদ রা. নিজের বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ সৈন্য রণাঙ্গনের পাশে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রাখেন।
যখন উভয় পক্ষ যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন খালিদ রা. লুকিয়ে রাখা বাহিনীকে সামনে আনেন।
তাদের দৃঢ় আক্রমণে পারসিক বাহিনী দিশেহারা হয়ে পলায়ন করতে থাকে। পারসিক বাহিনীর প্রধান আন্দারযাগর প্রচণ্ড পিপাসায় মৃত্যুবরণ করে।
আমগিশিয়ার গণিমত
অলাজারদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলাকালে ইরাক সীমান্তে বসবাসকারী খ্রিষ্টানরা অলাজারদের সহায়তা করে।
খালিদ রা. তাদেরকে উচিৎশিক্ষা দেয়ার জন্য ফুরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন।
খালিদ রা. শহরে পৌছে তাদের মল্লযুদ্ধের আহবান জানায়। সেখানকার খ্রিস্টান যোদ্ধা মালিক বিন কায়েস তার মোকাবেলায় এগিয়ে আসে। খালিদ রা. তার শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেন। এরপর ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়।
এই যুদ্ধে ৭০ হাজার পারসিক সৈন্য ও অসংখ্য আরব খ্রিস্টান নিহত হয়। বেঁচে থাকা সৈন্যরা ঘোড়া, গাধা, ধন-সম্পদ রেখেই পলায়ন করে। এরপর এই গণিমতের এক পঞ্চমাংশ তিনি মদীনায় পাঠিয়ে দেন।
আবু বকর সিদ্দিক রা. বলেন, কোনো মা খালিদের মতো বীর সন্তান জন্ম দিতে পারবে না।
হিরা বিজয়
ফুরাত নদীর তীরে আবর খ্রিস্টানদের পুরাতন একটা কেন্দ্র ছিল। মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হয়ে সেটা ঘেরাও করে।
শহরের বাসিন্দারা তাদের মোকাবেলা করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তারা তখন তাদের নেতা আমর বিন আব্দুল মাসিহকে সন্ধির জন্য পাঠায়।
খালিদ রা. তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, যুদ্ধ চাও নাকি শান্তি চাও?
সে বললো, শান্তি চাই।
খালিদ রা. আমরের হাতে বিষ দেখে বললেন, তুমি হাতে করে বিষ এনেছ কেন?
সে উত্তর দেয়, যদি সন্ধির আলোচনা করতে আমি ব্যর্থ হই তাহলে নিজ সম্প্রদায়কে কিভাবে মুখ দেখাবো? এর চেয়ে বিষ পান করা উত্তম।
খালিদ রা. তখন বিষের কৌটাটি হাতে নিয়ে বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার সময় না হবে ততক্ষণ তুমি জীবিত থাকবে।
এরপর তিনি নিম্নোক্ত দোয় পড়ে বিষ পান করলেন,
بسم الله خير الأسماء، رب الارض والسماء، الذي ليس يضر مع اسمه داء، الرحمن الرحيم
অর্থ: ‘সর্বোত্তম নামের অধিকারী আল্লাহর নামে পান করছি, যিনি আকাশ এবং পৃথিবীর প্রতিপালক,
যার অনুমতি ব্যতিত কোনো রোগ ক্ষতি করতে পারে না, যিনি পরম দয়ালু ও মেহেরবান।”
আমর বিন আব্দুল মাসিহ এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। সে বলে ওঠে,
যতদিন পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে তোমার মতো ব্যক্তিরা থাকবে ততদিন তোমাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না।
এরপর হিরার অধিবাসীরা বার্ষিক এক লক্ষ নব্বই হাজার দিরহামের বিনিময়ে সন্ধি চুক্তি করে।
আইনে তামামার যুদ্ধক্ষেত্র
পারস্যের মধ্যে তখন ক্ষমতা দিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। কিন্তু যখনই মুসলমানরা তাদের উপর আক্রমণ করলো তখন তারা একজোট হয়ে হামলা পরিচালনা করলো।
সে সময় মিহরান সৈন্য নিয়ে ইরাকের উত্তর দিকে আইনে তামারে শিবির স্থাপন করে।
তার সাহায্যের জন্য খ্রিষ্টান আরব সরদার উকবা বিন আবু উকবা নিজের গোত্রের সৈন্যদের নিয়ে অগ্রসর হয়।
যুদ্ধের শুরুতেই খালিদ রা. প্রবল আক্রমণ করে উকবাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন।
এটা দেখে শত্রুরা আর নয়া উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ার হিম্মত করে নি। তারা তখন নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে একটা দুর্গে আশ্রয় নেয়।
পারসিক বাহিনীর সেনাপ্রধান মিহরান ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালিয়ে যায়। খালিদ রা. তখন দুর্গটি অবরোধ করে, সেটিও জয় করে নেন।
আরব খ্রিষ্টানদের যুদ্ধ প্রস্তুতি
আইনে তামামার যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই আরব খ্রিষ্টান গোত্রগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
তাদের মধ্যে বনু গাসসান, বনু তানুখ, বনু কালব অন্যতম।
আবু বকর রা. তাদেরকে দমন করার জন্য হযরত ইয়াজ বিন গনাম রা. কে পাঠান।
কিন্তু তিনি একা এতগুলো গোত্রকে মোকাবেলা করতে পারছিলেন না। তাই তিনি খালিদ রা. নিকট সাহায্য চান।
খালিদ রা. কালক্ষেপণ না করেই সেখানে পৌছে গেলেন। খ্রিষ্টান আবরবা খালিদকে আসতে দেখে ঘাবড়ে যায়।
খ্রিস্টানদের নেতা উকাইদির বিন মালিক খালিদ রা. এর সাহসিকতা পারস্য এর বাহিনীর বিরুদ্ধে আগেই প্রত্যক্ষ করেছিল। তাই সে সন্ধি করতে আগ্রহী হয়।
কিন্তু তার গোত্র ও অন্যান্য খ্রিষ্টানরা যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিল।
পরিশেষে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এর সাথে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা পরাজিত হয়ে দুর্গে আশ্রয় গ্রহন করে। খালিদ রা. শেষ পর্যন্ত দুর্গও বিজয় করে নেন।
ফিরাজের যুদ্ধ
খালিদ রা. ইরাকে ইসলামের বিজয় পতাকা উড়িয়ে আরব গোত্রগুলোকে অনুগত করিয়ে নেয়ার পর ফিরাজ নামক এলাকার দিকে যাত্রা শুরু করেন।
এলাকাটি ছিল শাম, ইরাক ও জাজিরার সীমান্তবর্তী। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল নিজের পিঠ আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখা।
মুসলমানরা তখন ফিরাজ নামক এলাকায় সৈন্য সমাবেশ ঘটালো। এখানে তারা সেনাছাউনি স্থাপন করলো। কিন্তু মুসলমানদের ফিরাজে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে দেখে রোমানরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
রোমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতি
মুসলমানদের ঠেকাতে রোমানরা পারসিক যুবকদের সাহায্য কামনা করে। পাশাপাশি তারা আরব খ্রিষ্টানদেরকেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়।
রোমান সৈন্য, পারসিক যুবক ও আরব খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী এসে ফুরাত নদীর তীরে ছাউনী স্থাপন করে।
মুসলিম বাহিনী এবং রোমান বাহিনীর মধ্যে শুধুমাত্র ফুরাত নদী প্রতিবন্ধক ছিল।
নদী পারাপার
রোমানরা বললো, তোমরা নদী পার হয়ে আসো। অথবা আমাদের নদী পার হওয়ার সুযোগ দাও।
হযরত খালিদ রা. বললেন, তোমরাই নদী পার হয়ে এপারে চলে আসো। তখন রোমানরা বললো, তাহলে তোমরা পিছনে সরে যাও।
খালিদ রা. বললেন, তা হবে না। তোমরা নদীর নিকটস্থ নিচু ভূমিতে অবস্থান করতে পার। এই ঘটনা সংগঠিত হয় ১২ হিজরীর ১৫ জিলকদ মাসে।
যুদ্ধ
রোমান ও পারসিকরা নদী পার হওয়ার আগে বলছিল, নিজ দেশকে বাঁচাও। এই ব্যক্তি দ্বীনের জন্য লড়ছে এবং সে খুবই মেধাবী। আল্লাহর শপথ! এই ব্যক্তি বিজয়ী হবে আর আমরা অপমানিত হবো।
এরপরও তারা নদী পার হয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. মুসলমানদের বললেন, তাদের উপর হামলা করো এবং তাদেরকে কোনো অবকাশ দিও না।
এই যুদ্ধের শেষের দিকে রোমান ও পারসিকরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। তারা পালাতেও পারছিল না। তাদের পেছনে নদী।
ফলে সম্মিলিত বাহিনীর প্রায় সকল সৈন্যই ইন্তিকাল করে। যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ।
খালিদ রা. ফিরাজে ১০ দিন অবস্থান করেন। এরপর মুসলিম বাহিনীকে হিরায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এভাবেই মুসলমানরা সর্বপ্রথম দুই পরাশক্তি এবং আরবদের যৌথ হামলা মোকাবেলা করেন। আল্লাহ মুসলমনাদের যুদ্ধে বিজয় দান করেন।
রোমান তথা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ
ইসলাম পরবর্তী যুগে পৃথিবীর মধ্যে সুপার পাওয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ ছিল শাম। এটি সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
বর্তমানে শামের ম্যাপের সাথে প্রাচীন শামের ম্যাপের ব্যাপক পরিবর্তন রয়েছে।
পূর্বে শাম ছিল রোমান সাম্রাজ্যের একটা বৃহত্তম প্রদেশ। সেখানে বসবাস করতো খৃষ্টানরা। পাশাপাশি সে সময় ইয়ামানেও অনেক খৃষ্টানরা বসবাস করতো।
ইসলাম যখন আস্তে আস্তে প্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তখন রোমানরা নড়েচড়ে বসলো।
তারা ভাবতে লাগলো, যদি ইসলামকে সামনে অগ্রসর হতে বাঁধা না দেয়া হয় তাহলে অচিরেই নির্যাতিত খ্রিষ্টানরা খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করবে এবং গির্জার ছলচাতুরি ফাঁস হয়ে যাবে।
তাই তারা রাসূলের যুগ থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
এক সাহাবাকে হত্যা
রাসূল রা. হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে যখন আশেপাশের রাজা-বাদশাহদের নিকট দাওয়াতি চিঠি প্রেরণ করতে লাগলেন তখন তিনি তার সাহাবী হযরত হারিস বিন আমর রা. কে দূত হিসেবে রোমান সাম্রাজ্যের নিকট পাঠিয়েছিলেন।
হযরত আমর বিন হারিস রা. তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ায় তারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।
এরপর তারা ভূ-রাজনৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করে হযরত হারিস বিন আমর রা. কে হত্যা করে। নবীজি এই খবর জানতে পেরে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহন করেন।
এই প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়ার পর মুতার যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলমানরা এই যুদ্ধে মাত্র চার হাজার জন ছিল।
অপরদিকে রোমান বাহিনী ছিল এক লক্ষের কাছাকাছি।
এই যুদ্ধে হযরত খালিদ রা. এর সমর নীতির ফলে সহজেই মুসলমানরা বিজয় অর্জন করে।
রোমানদের বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ
এত বিশাল ভূখণ্ডে লড়াই করার জন্য প্রয়োজন হলো শক্তি। হযরত আবু বকর রা. শামের সীমান্তে খালিদ বিন সাঈদ রা. কে নিযুক্ত করেন।
কিন্তু তিনি তাকে রোমানদের বিরুদ্ধ হুটহাট যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে বললেন। কারণ, হঠাৎ যুদ্ধে নেমে পড়লে অঘোরে মারা পড়তে হবে।
খালিদ বিন সাঈদ রা.
সে সময় খালিদ বিন সাঈদ রা. সতর্কতার সাথে একটা বাহিনী নিয়ে রোমান সেনাপতি বাহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন।
হযরত খলিদ বিন সাঈদ রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই যুদ্ধে লড়াই করলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন, আমাদের নিকট সৈন্য সংখ্য খুব কম। তাই আরো সৈন্য দরকার।
খালিদ বিন সাঈদ রা. খেলাফতের দরকারে হযরত আবু বকর রা. কে বিষয়টা জানালেন। আবু বকর রা. তৎক্ষণাৎ নতুন বাহিনী তৈরি করেন।
নতুন বাহিনী
আবু বকর রা. স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ শুরু করেন। এক পর্যায়ে ইয়ামান, তিহামা, ওমান, বাহরাইন থেকে লোক আসতে লাগলো। আব বকর রা. তাদেরকে ইকরিমা বিন আবু জাহলের নেতৃত্বে একত্র করে শামে পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু এতেই প্রয়োজন পুর্ণ হয়ে যায় নি।
সেখানে আরো বড় বাহিনীর প্রয়োজন ছিল। যার প্রস্তুতি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রবীণ সাহাবায়ে কেরামই একমাত্র উপযুক্ত ছিলেন।
তাই আবু বকর রা. রাসূলের যামানা থেকে যাকাত উসূলকারী হযরত আমর ইবনে আ’স রা. কে জাকাত উত্তোলনের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে তাকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে আসলেন।
তার দায়িত্বে আরেকটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অর্পণ করেন। তারপর তাকে ফিলিস্তিন অভিমূখে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে আরো একটি বাহিনী গঠন করা হয়। যার দায়িত্ব ওয়ালিদ বিন উকবা রা. কে দেয়া হয়। তাকে জর্দান অভিমুখে প্রেরণ করা হয়।
আবু বকর রা. এর অসিয়ত
এরপর আরো একটি বাহিনী গঠন করা হয়। তার দায়িত্ব প্রদান করা হয় হযরত ইয়াজিদ বিন আবু সুফিয়ান রা. কে।
তিনি ছিলেন মুয়াবিয়া রা. এর বড় ভাই। এই বাহিনীকে আবু বকর রা. গুরুত্বের সাথে বিদায় জানান।
এই বাহিনীর আমিরকে হযরত আবু বকর রা. বলেন, আমি তোমাকে নেতৃত্ব প্রদান করেছি, যাতে তুমি নিজের যোগ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পার।
যদি তুমি সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হও তাহলে তোমাকে পদচ্যুত করা হবে। আর তোমাকে আল্লাহর প্রতি ভয়ের ব্যাপারে অসিয়ত করছি।
যখন তোমার নিকট শত্রুপক্ষের দূত আসবে, তখন তার সাথে বেশিক্ষণ অবস্থান করবে না।
তার নিকট কোনো গোপন কথা প্রকাশ করবে না এবং এমন কোনো কাজ করবে না, যার দ্বারা সে তোমাদের গোপন রহস্য বুঝে ফেলে।
প্রথম পরাজয় ও উত্থান
খালিদ বিন সাঈদ রা. সীমান্তে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
যখনই তিনি মুসলিম বাহিনীর আগমণের সংবাদ জানতে পারলেন তখন তিনি শামের সীমান্তে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করলেন। তিনি ফিলিস্তিনের মারজুস সুফফার নামক স্থানে পৌঁছেন।
এখানে রোমানদের এক বাহিনী প্রস্তুত ছিল। রোমানরা খালিদ বিন সাঈদ রা. এর বাহিনীর উপর আক্রমণ করে।
এই আক্রমণে খালিদ বিন সাঈদ রা. পরাজয় বরণ করেন। তার ছেলে ও আরো অনেক মুজহিদ নিহত হয়।
এরপর তিনি মদীনায় চলে আসেন। আবু বকর রা. তাকে মদিনায় রেখে শুরাহবিল বিন হাসানা রা., আবু সুফিয়ান রা. ও আবু উবায়দা রা. কে রোমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য শামের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।
যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিটি বাহিনী ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে থাকে।
মুসলমানদের তখন এই সম্মিলিত বাহিনী মিলে প্রায় একুশ হাজার সৈন্য ছিল।
রোমান বাদশাহ যখন মুসলমানদের এই সুবিন্যস্ত অভিযান জানতে পারলেন তৎক্ষণাৎ সে মার্চ করে রাজধানী হিমসে চলে যায়। এরপর সে কয়েকটা ইউনিট গঠন করে তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়।
যাতে মুসলমানরা একত্রে লড়াই করতে না পারে।
রোমানদের এই ইউনিটগুলোর সম্মিলিত হিসাব প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো।
মুসলিম সেনাপতিরা পরষ্পর যোগাযোগ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারা যেভাবেই হোক একত্রিত হয়েই যুদ্ধ করবেন।
তখন আবু বকর রা. তাদেরকে ইয়ারমুকে এসে শিবির স্থাপনের নির্দেশ দেন।
শামে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এর আগমন
এ সময় হযরত আবু বকর রা. খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে ইরাকের দায়িত্ব মুসান্না বিন হারিসা রা. এর নিকট অর্পণ করে তার সৈন্য নিয়ে দ্রুত শামে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
শামে তখন সাহাবাদের ইউনিটগুলো একত্রিত হতে লাগলো। এর মধ্যে রোমানরা ও আসা যাওয়া করতে লাগলো।
এমন কঠিন মুহুর্তে রোমানদের ফাঁকি দিয়ে ইরাক থেকে শামে যাওয়াটা অনেক কঠিন ছিল।
কিন্তু তারপর ও তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং রোমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ৯ হাজার মুজাহিদ নিয়ে হিরা থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে মার্চ করা শুরু করেন।
এদিকটা ছিল একটা মরুভূমি অঞ্চল। এখানে ছিল না কোনো পানি, ছিল না কোনো গাছ-পালা।
এই মরুভূমিটি কিরকুক থেকে সুয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিরকুক হলো উত্তর ইরাকের দজলা নদীর পূর্ব পাশে।
এই মরুভূমিতে পথপ্রদর্শক ছিলেন রাফে বিন উমাইয়া রা.। তিনি তখন খালিদ রা. কে বললেন,
একজন দ্রুতগামী অশ্বারোহীও তো এই মরুভূমি সহজে পাড়ি দিতে পারবে না। আর আপনি পুরো দল নিয়ে এখান দিযে পাড়ি দেয়ার চিন্তা করছেন?
খালিদ রা. বললেন, এ ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।
খালিদ রা. এর বুসরা বিজয়
শামে পৌছে খালিদ রা. দেখলেন, রোমানদের সাথে যুদ্ধ করার মুসলিম বাহিনীতে বড় ধরণের দুর্বলতা রয়েছে। দেখতে পেলেন এখন পর্যন্ত মুসলমানরা কোনো দুর্গ বা শহর জয় করে নি।
তাই তিনি যাত্রাপথে বুসরায় শিবির স্থাপন করেন। এরই মধ্যে অন্যান্য মুসলিম সেনাবাহিনীরা সাহায্য নিয়ে পৌছে যান। শহরবাসীরা জিজিয়া দেওয়ার শর্তে তরবারি ফেলে দেয়।
এভাবেই সন্ধির মাধ্যমে শহরটি মুসলমানদের হাতে চলে আসে।
আজনাদাইনের যুদ্ধ
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. ইরাকের দায়িত্ব হযরত মুসান্না বিন হারিসা রা. এর নিকট দিয়ে ইরাক ত্যাগ করে শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
শামের সে সময় আরো বেশ কিছু মুসলিম সিপাহসালার নিজেদের বাহিনী নিয়ে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছিরেন।
সর্বপ্রথম খালিদ রা. শামে পৌছে বসরা জয় করেন। এরপর তিনি অন্যান্য মুসলিম আমিরদের সাথে ময়দানে মিলিত হন।
যারা হলেন, হযরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ রা.। হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা রা.। হযরত ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান রা.।
রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ভাই ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে ফিলিস্তিনের রামাল্লা ও বাইতে জিবরিনের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছিল।
এই সৈন্য শামে নিযুক্ত অন্য একজন মুসলিম সিপাহসালার হযরত আমর ইবনে আস রা. এর মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল।
রোমানদের গুপ্তচর
চূড়ান্ত যুদ্ধের পূর্বে হিরাক্লিয়াসের ভাই এক আরবকে গুপ্তচর হিসেবে মুসলিম শিবিরে পাঠায়। সেই ব্যক্তি ফিরে গিয়ে বললো,
তারা রাত কাটায় ইবাদতে আর দিন কাটায় অশ্বপিঠে যুদ্ধ করে।
পাশাপাশি সে এটাও বলে, তারা নিয়ম-কানুন মেনে চলার প্রতি এতটাই যত্নবান যে, যদি শাসনের ছেলে চুরি করে তাহলে তার হাত কেটে ফেলা হয়।
সে যদি কোনো নারীর সাথে অপকর্ম করে, তাহলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে।
এই কথা শুনে রোমান সেনাপতি বললেন, তাহলে তো আমার তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিৎ নয়। হায়! যদি আমাকে তাদের সাথে লড়াই না করতে হতো!
যুদ্ধক্ষেত্র
মুসলিম বাহিনীগুলো আজনাদাইন নামক এলাকায় এসে উপস্থিত হলো। হযরত আমর ইবনে আস রা. ও নিজের বাহিনী নিয়ে এখানে উপস্থিত হলেন।
এ সময় মুসলমানদের সম্মিলিত বাহিনীর মুজাহিদদের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের মতো। মুসলিম আমিরগণ একমত হয়ে খালিদ রা. কে যুদ্ধের আমির নির্বাচন করা হয়।
হযরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ, শুরাহবিল বিন হাসানা, আমর ইবনে আস ও ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান রা. তার অধীনে যুদ্ধ করছিলেন।
শেষ পর্যন্ত রোমানরা পরাজয় বরণ করে। হিরাক্লিয়াসের ভাই তাজারিক নিহত হয়। যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানরা বিজয়লাভ করে।
এরপর খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এগিয়ে যান ইয়ারমুকের প্রাঙ্গনের দিকে।
মুসান্না বিন হারিসা রা. ও ইরাক
হযরত মুসান্না বিন হারিসা রা. ইরাকের দায়িত্বভার গ্রহন করেন খালিদ রা. এর নিকট হতে। যখন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. রোমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধের জন্য ইয়ারমুকে গমন করলেন তখন তিনি আবু বকর রা. এর নির্দেশে মুসান্না বিন হারিসার হাতে ইরাকের দায়িত্ব দিয়ে যান।
মুসান্না বিন হারিসা রা. তখন ইরাকের শহরগুলি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে মনোনিবেশ করেন। সে সময় খালিদ রা. এর ইরাক ত্যাগ ছিল খুবই অনাকাঙ্খিত। তখনও ইরানীরা পুরোপুরি পরাজয় বরণ করে নি।
বিভিন্ন স্থানে তারা ঘাপটি মেরে ছিল। সে সময় হযরত মুসান্না বিন হারিসা রা. এর হেডকোর্টার ছিল ইরাকের ঐতিহাসিক শহর হিরাতে।
আর খালিদ রা. এর সাথে নয় হাজার সৈন্যের ইরাক ত্যাগে পারসিকরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলো। খালিদ রা. জানতেন, তিনি অনুপস্থিত থাকা অবস্থায় পারসিকরা আক্রমণ করতে পারে।
তাই তিনি অসুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের মদীনায় পাঠিয়ে দেন। যেহেতু মুসান্না রা. কে আবু বকর রা. যুদ্ধের জন্যই ইরাকে পাঠিয়েছিলে। তাই তিনিও দায়িত্ব পাওয়ার পর সতর্ক থাকলেন।
ইরাকের আক্রমণ
ইরাকের সিংহাসনে তখন শাহরিয়ার ইবনে আর্দেশীর ক্ষমতায় বসেছে। সে মূলত পারস্যের রাজ বংশের কেউ নয়।
কিন্তু সে তার সময়কালের বড় যোদ্ধা ছিল।
তাই তার ক্ষমতা দখল করার সময় কেউ কিছু বলে নি।
যখন সে জানতে পারে, মুসলমানদের অর্ধেক সৈন্য ইরাক ত্যাগ করেছে তখনই সে মুসলমানদের হাত থেকে ইরাক উদ্ধারের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলো।
তখন সে পারস্যের অন্যতম সেনাপতি হরমুজের নেতৃত্বে দশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন। তারা এসে হীরায় উপস্থিত হলো।
মুসান্না রা. তখন তাদেরকে হিরার সীমানা পর্যন্ত আসতে দেয়াটা উচিৎ মনে করলেন না।
তাই তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে ইরাকের সীমান্ত এলাকা বাবেল নামক স্থানে ছাউনী স্থাপন করেন।
এরপর মুসান্না বিন হারিসা রা. এর সাথে যুদ্ধ শুরু হয় ইরানীদের। তারা দাঁড়ানোর ঠাঁই পর্যন্ত পাচ্ছিল না।
পরিশেষে তারা ময়দান থেকে পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে মুসান্না রা. সঠিকবাবে বিন্যস্ত করে।
মুজাহিদ বাহিনীর ডান দিকের দায়িত্ব মুআন্না রা. কে ও বাম দিকের দায়িত্ব মাসুদ রা. কে দেয়া হয়।
মুসান্না রা. তাদেরকে ধাওয়া করতে করতে পারস্যের রাজধানী পর্যন্ত পৌছে যান।
মুসান্না রা. এর নিকট সৈন্য কম থাকায় তিনি ফিরে আসেন। সে সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মদীনা গমন করেন।
এটা ১৩ হিজরীর ঘটনা।
ইরাকে ক্ষমতাশীলদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব
যুদ্ধের ময়দান থেকে হরমুজ পালিয়ে আসার পর ইরাকের রাজা শাহরিয়ার ভয় পেয়ে যান।
যে কোনো মুহুর্তে মুসলমারা আমাদের শহর দখল করে নিতে পারে। এই ভয়ের মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়।
তার মৃত্যুর পর তার পুত্র সাবুর সিংহাসনে বসলো। সে বসে ফররোখযাদ নামক একজনকে মন্ত্রী বানালো।
এরপর তারা শুরু করলো নতুন প্ল্যান। কিন্তু মদীনার মুজাহিদরা তাদের সেই প্ল্যান নস্যাৎ করে দেয়।
মদীনায় মুসান্না বিন হারিসা রা.
মুসান্না বিন হারিসা রা. হযরত বশির বিন ফাসামি রা. কে ইরাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
মদীনায় পৌছার পর জানতে পারেন, আবু বকর রা. অসুস্থ। তখন মুসান্না রা. তার সাথে দেখা করেন।
আবু বকর রা. এর অন্তিম সময় ছিল সেটি। তিনি ইরাকের রণক্ষেত্রের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন।
মুসান্না রা. ইরাকের অবস্থা জানিয়ে বললেন, আমার সাথে আরো কিছু সৈন্য দিন। যাতে আমরা পুরো ইরাক জয় করতে পারি।
এদিকে তখন মদীনায় তেমন একটা মানুষ ছিল না। যুবকরা ও নওমুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরা অন্যান্য রণাঙ্গনে যুদ্ধরত ছিল। তাই তখন নতুন যোদ্ধা ব্যতিত এই অভিযান সম্ভব নয়।
তখন আবু বকর রা. ওমর রা. কে ডেকে বললেন, সম্ভবত এটি আমার জীবনের শেষ দিন।
যদি আমি আজ মৃত্যুবরণ করি তাহলে তুমি সন্ধা পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই মুজাহিদ সংগ্রহ করে মুসান্নার সাথে পাঠিয়ে দিবে। আমার শোক যেন তোমাকে বাধাগ্রস্থ না করে।
আবু বকর রা. সেই রাতেই ইন্তিকাল করেন। দিনটি ছিল ২৮ আগষ্ট ৬৩৪ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ১৩ হিজরীর জুমাদাল আখিরাহ্ মাস।
জিহাদের জন্য আহবান
উমর রা. পরেরদিন মসজিদে এসে জিহাদের জন্য লোকদের আহ্বান করেন।
পরপর তিনদিন লোকদের আহ্বান করার পর সর্বপ্রথম বনু সাকিফের আবু উবায়েদ বিন মাসউদ জিহাদের জন্য নাম লিখান।
তাকে দেখার পর বনু সাকিফের আরো অনেকেই জিহাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
এদিকে মুসান্না রা.ও মানুষকে জিহাদের পথে আহ্বান করতে থাকেন।
অবশেষে বড় একটি বাহিনী তৈরি হয়ে যায় জিহাদের জন্য। ওমর রা. তখন আবু উবায়েদ বিন মাসউদকে দলের আমির হিসেবে নির্ধারণ করেন।
মুসান্না রা. তো সেনাপ্রধান। তাই এটা যেন পাঠকের মনে সংশয় সৃষ্টি না করে।
সে সময় কেউ কেউ এই আপত্তি তোলে, এত এত সাহাবী উপস্থিত থাকতে একজন তাবেয়ীকে কেন আমির নির্ধারণ করা হলো?
ওমর রা. তখন বললেন, যে জিহাদের জন্য সর্বপ্রথম সাড়া দিয়েছে তাকেই আমি আমির বানাবো। অন্য কাউকে নয়।
খলিফা আবু বকর রা. এর মৃত্যু
১৩ হিজরীর জুমাদাল উখরা মাসে খলিফা আবু বকর রা. অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি বুঝতে পারেন, তার সময় শেষ হয়ে আসছে। তখন তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের বলেন,
তোমরা আমার অবস্থা দেখতেই পাচ্ছ। আমার ধারণা, আমি সেরে উঠবো না। আল্লাহ আমার হাত থেকে তোমাদের বাইয়াত খুলে নিচ্ছেন।
সুতরাং তোমরা অন্য একজনকে আমির বানিয়ে নাও।
আবু বকরকে বিষপান
আবু বকর রা. এর মৃত্যুর প্রায় ১ বছর পূর্বে একবার আরবের বিখ্যাত ডাক্তার হারিস বিন কালাদা রা. এক সঙ্গে খাবার খেতে বসেছিলেন।
হারিস রা. এক লোকমা খাবার মুখে নিয়ে বলে উঠেন, হে আল্লাহর রাসূলের খলিফা! খাবার থেকে হাত উঠিয়ে ফেলুন।
এতে এক বিশেষ ধরণের বিষ মিশ্রিত আছে। ঠিক এক বছর পর এর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়।
ইতিহাস গ্রন্থে এটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই যে, কে এই বিষ মিশিয়েছিল? তবে আল্লামা ইবনুল আসির রহ. বলেন, ইহুদীরাই মিশিয়েছিল।
এই বিষের ক্রিয়ায় এক বছর পর একই দিনে আবু বকর রা. ও হারিস বিন কালাদা রা. মৃত্যুবরণ করেন।
আবু বকর রা. এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ
নিজের মৃত্যুর বিষয়টি অনুভব করার পর হযরত আবু বকর রা. বিখ্যাত সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ ও উসমান বিন আফফান রা. এর সাথে পরামর্শ করেন।
আবু বকর রা. পূর্ব থেকেই উমরকে খলিফা হিসেবে দেখতে চাচ্ছিলেন। তিনি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. কে বললেন, উমরের ব্যাপারে তোমার অভিমত কি?
তখন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. বলেন, আল্লাহর শপথ! তার ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত সবচেয়ে উত্তম।
এরপর আবু বকর রা. উসমান রা. কে ডেকে ওমর রা. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, আমরা কেউ ই ওমরের সমকক্ষ নই। তিনি আমাদের থেকে অনেক উত্তম।
এরপর আবু বকর রা. উসায়েদ ইবনে হুজায়ের রা. কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনিও প্রসংসামূলক বাক্য বললেন।
আবু বকর রা. হযরত তালহা রা. কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ওমর তো লোকদের সাথে কঠোর আচরণ করে।
তখন আবু বকর রা. বললেন,
তা ঠিক হয়ে যাবে। এখন যদি আমি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করি তাহলে অন্তত দৃঢ়ভাবে বলতে পারবো যে, সর্বোত্তম ব্যক্তিকে খলিফা বানিয়েছি।
এরপর হযরত আবু বকর রা. অসিয়তনামা লেখার জন্য উসমান রা. কে ডাকলেন। তিনি লিখলেন,
আবু বকর বিন আবু কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অসিয়ত।
এরপরই আবু বকর রা. অজ্ঞান হয়ে যান। উসমান রা. জানতেন যে, তিনি ওমরকে খলিফা বানাতে চাচ্ছেন। তাই তিনি শঙ্কা অনুভব করলেন,
যদি অজ্ঞান অবস্থায় খলিফার মৃত্যু হয়ে যায়! তাই তিনি এরপর লিখে দিলেন, আমি তোমাদের জন্য উমরকে খলিফা হিসেবে নির্ধারণ করছি।
এরপর আবু বকর রা. এর জ্ঞান ফিরে এলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি লিখেছ? তখন উসমান রা. তা পড়ে শোনান।
আবু বকর রা. বললেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তোমাকে মুসলমানদের পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
মৃত্যু
হযরত আবু বকর রা. ২২ জুমাদাল আখিরাহ ১৩ হিজরীতে মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া ত্যাগ করেন। আল্লাহ তাকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন।
আবু বকর রা. এর খেলাফতকাল ছিল সর্বোমোট ২ বছর ২ মাস।
তথ্যসুত্র
এই লেখাটি সংকলন করতে যেসব বইয়ের সাহায্য নেয়া হয়েছে,
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। খন্ড ১-৩। মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। ইসলামিক ফাউন্ডেশন
আবু বকর সিদ্দিক। ড. আলী মুহাম্মাদ আস সাল্লাবী
আবু বকর রা. জীবনী। মীনা বুক হাউজ
এ ছাড়াও অনলাইনের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং পিডিএফ