আই লাভ কুরআন একটি অনবদ্য সংকলন। একটি হৃদয়ঘটিত আবেগ-অনুভূতি। একঝাঁক চিন্তার আঁধার ও শীতলতার উপকরণ।

বইটা হঠাৎ করেই হাতে পাই। তার আগে বইটা সম্পর্কে কিছু না বলা কথা বলা উচিৎ। যদিও এই ক্ষুদ্র লিখনি কারো উপকারে আসবে নাকি, জানি না। তারপরও লেখা। যদি কেউ ফিরে আসে….

প্রতিদিনকার মতোই রকমারি ও ওয়াফিলাইফ এর হোম পেজে ক্রল করছি নতুন বইয়ের খোঁজে। কোন বই সংগ্রহ করবো, এমন একটা নেশা সর্বদাই থাকে।

একদিন ওয়াফিলাইফ এর হোম পেজে চোখে পড়লো আই লাভ কুরআন বইটি। নামটা কেমন যেন চেনা চেনা। ক্লিক করে প্রবেশ করলাম।

অন্যতম একজন পরিচিত ব্যক্তি আতিক উল্লাহ হাফি. এর লিখিত বই এটি। বেশি দিন আগে কথা নয়। ১৭/১৮ সালের দিকে যখন মারকাযুল কুরআন আশরাফাবাদে পড়তাম তখন আতিক উল্লাহ সাহেবের বইগুলো ছিল আমাদের নিকট খুব আকর্ষণীয়।

লেখকের থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে, জীবনের বিন্দু বিন্দু গল্প, গুরফাতাম মিন হায়াত, আকাশের ঝিকিমিকি তারা, হুদহুদের দৃষ্টিপাতসহ অন্য সকল বইগুলোই পড়া হয়েছে।

কিন্তু মনে থাকে আর কয়টা লেখা! পৃষ্টার পর পৃষ্ঠা পড়ে যাই। একেকটা বই শেষ করার পর মনে হয়, আহহা! যদি পুরো বই মনে থাকতো!

কখনো কখনো মনে থাকে বৈকি, কিন্তু সপ্তাহখানেক পর যেই লাউ সেই কদু। কষ্ট করেও মনে করতে পারি না বইয়ের তথ্যগুলো।

ওয়াফিলাইফে প্রতিটা বইয়েরই শুরুর কয়েক পৃষ্ঠা পড়া যায়। আই লাভ কুরআন বইটার “পড়ে দেখুন” বাটনে ক্লিক করলাম।

অসাধারণ একটা গল্প চোখে পড়লো শুরুতে। সূরা বাকারার ১৫৪ নং আয়াতটি,

وَ لَا تَقُوۡلُوۡا لِمَنۡ یُّقۡتَلُ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ اَمۡوَاتٌ ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ وَّ لٰکِنۡ لَّا تَشۡعُرُوۡنَ

যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়, তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পার না।

আয়াতটা পড়ে এবং বইয়ের গল্পটা পড়ে হৃদয়ের গহীনে কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আসলেই তো! শহীদি তামান্না তো সর্বদাই থাকে।

এরপরও দুনিয়ার মোহে পড়ে যাই। ভুলে যাই শাহাদাতি প্রতিজ্ঞা। নিজের মনে মনে করা জিহাদী বাইয়াত। কেমন যেন ভীরু ভীরু লাগলো নিজেকে।

বইটা সংগ্রহ করতে হবে। পড়ে দেখতে হবে – ভেতর থেকে এমন একটা আওয়াজ পেলাম। চাইলেই তো আর সাথে সাথে সংগ্রহ করা যায় না। টাকা লাগবে।

পরেরদিন যথারীতি ইন্সটিটিউটে গেলাম। সেদিন সম্ভবত আমাদের আফতাব স্যারের কোনো ক্লাস ছিল। সেই ক্লাসে স্যার আসছিলেন না।

ছাত্ররা যে যার মতো চিল্লাচিল্লি ও কথাবার্তা বলছিল। কোনো এক কথাপ্রসঙ্গে আমার ক্লাসমেট পারভেজ, মাহমুদ, হৃদয় ও রিফাত ভাইদের নিকট বইয়ের পিডিএফ এ পড়া আয়াতটা ব্যক্ত করলাম।

হৃদয়ে আমার আবেগ ছিল। চাচ্ছিলাম স্রষ্টার দিশা। জানি না, তারা কিছু বুঝেছে নাকি। আমার কথা তারা শুনলো, এই আরকি।

হপ্তাহখানেক পর ওয়াফিলাইফে অর্ডার দিয়ে আই লাভ কুরআন ও সুইটহার্ট কুরআন বইটা আনলাম।

বইগুলো যখন হাতে পেলাম, তখন প্রথমেই আমি বইটা খুলে আমার দেখা আয়াতটা খুঁজছিলাম।

কিন্তু তা তো বইতে দেখতে পাচ্ছি না। আরে কি একটা অবস্থা! দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বইয়ের পৃষ্ঠা ঠিক আছে তো? আমাকে আবার ঠকায় নি তো? তাহলে বাকারার ১৫৪ আয়াতের ঘটনা কই?

আবার প্রবেশ করলাম ওয়াফির ওয়েবসাইটে। পিডিএফে ক্লিক করে দেখলাম, সেই একই ঘটনালিখিত পৃষ্ঠা আসলো। তাহলে আমার বইতে তা নেই কেন?

একটু পর পৃষ্ঠা নম্বরে খেয়াল করে দেখলাম, তা হলো বইয়ের ১৫৪ পৃষ্ঠা। এত বড় ঠক! কেমন যেন আগ্রহ চলে গেল।

কারণ, ভেবেছিলাম, শুরুতেই এই ঘটনা থাকবে। আর বইটা আতিক উল্লাহ সাহেবের অন্যান্য বইয়ের মতো গল্প থাকবে অনেক।

কিন্তু তা নেই তাতে। শিক্ষামূলক কথা লেখা। কুরআনের আয়াত লেখা। বুকসেলফের এক কোণায় রেখে দিলাম। কখনো মন চাইলে পড়বো বলে।

এরপর দেখতে দেখতে মাসখানেক কেটে গেল। বইটা শোভা পাচ্ছে অন্য দশটা বইয়ের মতো।

তখন আমার ডিপ্লোমার ২য় সেমিষ্টারে ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। প্রতি পরীক্ষার মাঝেই প্রায় ৩/৪/৫ দিন করে ফাঁকা সময় থাকে।

একদিন হঠাৎ কি মনে করে বইটা হাতে নিলাম। বইটা পড়বো বা অন্যান্য বইয়ের মতো পুরোটা শেষ করবো, এমন কোনো ইচ্ছা ছিল না।

নিতান্তই কিনেছি বলে হক আদায়ের জন্য হাতে নিয়েছিলাম। শুরু করলাম পড়া।

আশআরী ঘরানা, কুরআনী কান্না, হিযবি মিনাল কুরআন, আই লাভ ইউ, কুরআনের প্রজন্ম, জীবনের প্রয়োজনে কুরআন শিরোনামে লেখাগুলো পড়তে পড়তে কখন যে ১০০ পৃষ্ঠার মতো পড়ে ফেললাম, টেরও পেলাম না।

মনের অজান্তেই একটা ভালোলাগা তৈরি হলো বইয়ের প্রতি, কুরআনের প্রতি, হিযবের প্রতি। আমি হাফেজ হয়েছিলাম বাবা-মায়ের ইচ্ছায়।

হাফেজ হওয়ার পর থেকে এই বই পড়ার আগ পর্যন্ত কখনো সেচ্ছায় কুরআন নিয়ে বসি নি। একান্তই বাধ্য হয়ে কুরআন পড়তাম।

হেফজখানায় থাকতে হুজুরদের ভয়ে পড়তাম। কিতাব বিভাগে থাকতে হুজুরদের তাগিদে পড়তাম।

বাসায় থাকলে আব্বার ভয়ে পড়তাম। রমজানে তারাবীহ এর জন্য পড়তাম। আর আমার নিয়ম ছিল, প্রতি বন্ধে আমার চাচাকে এক খতম কুরআন শোনানো। কি যে বিরক্ত লাগতো আমার!

মেশকাত পর্যন্ত পড়লাম ঠিকই। কিন্তু কুরআনের সাথে মুহাব্বাত হয় নি কখনো।

তাই তো কখনো কখনো কুরআনের আয়াত কোনোটা বুঝলে ভাবলাম, সত্যিই কি আল্লাহ এটা বলেছিলেন?

আই লাভ কুরআন বইয়ের হিযবি মিনাল কুরআন শিরোনামে লেখাটা পড়ে ভাবলাম, সত্যিই তো প্রতিদিন একটা হিজব থাকা উচিৎ। কিন্তু আমার তো তা নেই।

নিয়্যত করলাম, দুনিয়া জাহান্নামে যাক। তারপরও দরকার হলে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ (হিজব) কুরআন তেলওয়াত করবো ইনশাল্লাহ।

আলহামদুলিল্লাহ শুরু করলাম। কিন্তু…… আমি কুরআন পড়তাম তখন আমার স্মার্ট ফোনে।

ইন্সটিটিউটে ক্লাসের ফাঁকে, মসজিদে নামাজের আগে, বাসে উঠার পর সময়গুলোতে।

যদিও স্মার্ট ফোনে কুরআন পড়তাম, কিন্তু একটা অপার্থিব “মুসহাফের ছোঁয়া” থেকে বঞ্চিত রইলাম।

আর এই স্মার্ট ফোনের ব্যাপারে যদি বলি, এটা হলো, শয়তানের বাক্সের ন্যায়।

এটাতে কুরআনও পড়াতাম আবার ইউটিউবসহ বিভিন্ন নেটের জগতে ঘুরতাম। যেখানে পাপের ছড়াছড়ি। অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। তাদের কাজগুলো পুরো পশুর ন্যায়।

একদিন একটা বিশেষ কারণে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মোবাইলে কুরআনও পড়ি, আবার অশ্লীল…………..। ভাবলাম, মোবাইল আর চালাবো না।

এই ভাবনা তো আর থেমে থাকে না। যতই মোবাইল ড্রয়ারে বন্দী করে রাখি না কেন, শয়তানের ধোঁকা থেকে বের হতে পারি না।

শয়তান বলে, আরে তুমি যে মোবাইল ড্রয়ারে রেখেছ, তোমার না কুরআন পড়তে হবে। নাও পকেটে নাও।

এই যে কুরআনের নামে শুরু হতো আরেক জগতে ভ্রমণ।

তারপর আমি নিজের উপর রাগে, ক্ষোভে, আক্রোশে, হতাশায়, আত্মগ্লানিতে হাঁতুড়ি দিয়ে মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেলি।

আমি জানতাম, এই মোবাইল ছাড়া আমি অনেকটা অচল হয়ে যাব। কিন্তু হাল ছাড়ি নি।

যদিও এই স্মার্টফোন না থাকায় ইন্সটিটিউটে অনেক বিপাকে পড়তে হয়েছে। তবে পিছপা হই না।

আল্লাহর রহমতে এখন স্মার্টফোন থেকে বহুদূরে আছি। আলহামদুলিল্লাহ।

জীবনে একটা নিয়্যত করেছি, কখনো আর এই স্মার্ট ফোন ব্যবহার করবো না। আল্লাহ যেন তাওফিক দেন।

আর যদি করতেই হয় তাহলে বিয়ের পরে। এর আগে মরে গেলেও নয়।

মোবাইল তো নাই। তাই বলে কি কুরআন পড়া থেমে থাকবে। তা কি করে হয়? ভাবলাম, একটা মুসহাফ সংগ্রহ করি।

বইয়ে লেখক ছোট ছোট কুরআনের কথা বলেছে, ভালো লাগলেও তা ইচ্ছা হয় নি সংগ্রহ করার।

স্বাভাবিক একটা অ্যারাবিয়ান ছাপা চিকন সাইজের কুরআন চাচ্ছিলাম।

যেটা হাতে নিয়ে পড়তে সমস্যা হবে না। কুরআনের ওজন (!) বেশি হলে পড়ার আগ্রহ ছুটে যেতে পারে।

ল্যাপটপে বসে অনলাইনে খোঁজ লাগালাম।

এক ভাই বললেন, তার নিকট অমন কুরআন আছে। ৪২০৳ পড়বে। আমি আগ পিছ না ভেবেই উনাকে পেমেন্ট করে দেই।

আলহামদুলিল্লাহ, ভাই ৩/৪ দিনের মধ্যেই কুরআনখানাটি পাঠিয়ে দেন বাসার ঠিকানায়।

নতুন নুসখা হাতে নিয়ে এক অপার্থিব ভালোলাগা নিজের মধ্যে তৈরি হলো।

এটা আমার কুরআন। এটা আমার নুসখা। এটা আমার মুসহাফ। এটা আমার……। একান্তই আমার। আমি এটার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে কথা বলবো।

ভাবতেই গায়ে শিহরণ বয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ মাদ্রাসার এককালের তালিবে ইলম হওয়ায় কুরআনের অর্থ খানিকটা বুঝি।

তখন পড়তে কি যে ভালো লাগে! বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

আই লাভ কুরআন

যেই আমি কখনো বছরের অন্যান্য দিনে কুরআন পড়া তো দূরের কথা, ছুঁয়ে দেখারও কল্পনা করি নি, সেই আমি এখন প্রতিদিনের হিজব আদায় না করলে ঘুমাতে পারি না।

আমি রমজানে শুধু তারাবীহ এর জন্য পড়তাম, তাও নিজের অংশটুকু সেই আমি এখন রমজানে প্রতিদিন এক মঞ্জিল করে পড়ছি আলহামদুলিল্লাহ।

যেই আমি এককালে মোবাইলের পাগল ছিলাম, সারাদিন ঘন্টাখানেক মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকতাম, সেই আমি এখন মোবাইল ছাড়া দিব্যি ভালো আছি।

আমি হাফেজ হয়েও কুরআন ভুলতে বসেছিলাম, সেই আমি আলহামদুলিল্লাহ নিয়মিত কুরআন পড়ার সুবাদে কাঁচা পারা ইয়াদ হয়ে যাচ্ছে।

যেই আমি এককালে আল্লাহর নাফরমানি করতে বিন্দুমাত্রও ভাবতাম না, সেই আমি এখন…….. কুরআনের আয়াতগুলো সারাদিন মাথায় ঘুরে।

যেই আমি এককালে প্রাচাত্যের চাকচিক্যে পড়ে বিজ্ঞান দিয়ে কুরআন যাছাই করতাম, সেই আমি এখন কুরআন দিয়ে বিজ্ঞান, রাষ্ট্র, সমাজ, সংষ্কৃতি, সাহিত্য, ভাব যাছাই করি।

আলহামদুলিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। হয়তো আমি এতটা পরিবর্তিত হতাম না, যদি লেখকের এই বইটি না পড়তাম।

বইটা প্রত্যেক পাঠকের বছরে একবার করে পড়া উচিৎ। কারণ, প্রতি বছর মানুষের জ্ঞান বাড়ে। সমৃদ্ধ হয়। শয়তানের ধোঁকায় অন্তরে দাগ পড়তে থাকে।

তখন এই বইটি হতে পারে আশার আলো। এই বইটি হতে পারে ভেসে আসা খরকুটো। এই বইটি হতে পারে….. অনেক কিছু।

আল্লাহ লেখকের নেক হায়াত দান করুন। তার ইলমি কাজগুলোকে কবুল করে নিন।

তার নেক মাকাসিদগুলো কবুল করে নিন। তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, উস্তায ও আহবাবদের কবুল করে নিন। আমীন।

(কোনোদিন যদি লেখকের সাথে দেখা হয়, আমি হয়তো উনাকে কিছু বলতে পারবো না লজ্জায় বা জড়তায়। তবে উনাকে দেখলে ভালো লাগবে, এটাই তো অনেক!)

গাজ্জার জন্য অনুদান

৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে তুফানুল আকসা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জায় অসংখ্য মানুষ আহত ও শহীদ হয়েছে। বহু মানুষ নিজেদের ঘর-বাড়ী হারিয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে গাজ্জার ৯৮% মানুষ অনাহারে জীবন-যাপন করছে। গাজ্জার মানুষের এই দুঃসময়ে আমরা যদি তাদের পাশে না দাঁড়াই তাহলে কে দাঁড়াবে?

আর-রিহলাহ ফাউন্ডেশন তুফানুল আকসা যুদ্ধের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের গাজ্জার জন্য ডোনেশন সংগ্রহ করে আসছে। এই মহান কাজে আপনিও আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন।

অনুদান দিন

Scroll to Top